বেহুলা মন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দুপুরের দিকে ক্ষুধাটা বেশ মোচড় দিয়ে ওঠে। ব্রেন সংকেত পাঠানো শুরু করে নানাভাবে। মাথা ধরে থাকে, এসিডিটি বাড়ে, কখনো কখনো কোনো কিছুতেই মনঃসংযোগ করা যায় না। দুপুরে খাওয়া মানেই কমন জায়গাগুলোতে বেশি করে যাওয়া, হ্যান্ডব্যাগটা প্রতিদিন যেভাবে ব্লিচিং পানি দিয়ে স্প্রে করি, যেভাবে তো আর ব্যাগটাকে করতে পারব না। কর্মস্থলে যাওয়া–আসার মাঝে যদি এ ব্যাগটাই ভাইরাস বাহক হয়ে যায়? বড্ড বেশি ভাবি, তাই না!

ইদানীং ভাবনাটা বেহুলাকে নিয়েও হয়। বেহুলাকে চেনেন তো? মনসামঙ্গলের প্রধান নারী চরিত্র। বেহুলার সঙ্গে আমার একটা প্রাগৈতিহাসিক যোগসূত্র আছে। আমার জন্ম যে জেলায়, অর্থাৎ চাঁদপুরের নামকরণ নাকি হয়েছে বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সওদাগরের নামে, তাঁর সপ্তডিঙ্গা ভিড়ত এসে এই নদীবন্দরে। এই নামকরণের কাহিনিকে আরও পোক্ত করেছে চাঁদপুরের কচুয়ার মনসামুড়া নামক জায়গাটি। নামকরণের এই মিথ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, তবে তা নিয়ে গবেষণা করে সময় নষ্ট করার সময় নেই আমাদের! করোনাকালে আমার এই বড্ড বেশি ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার একজন সহকর্মী বলেছিলেন, করোনা হলো সেই সাপ, যতই লোহার বাসর ঘর তৈরি করা হোক, সে ঢুকবেই। তখন থেকেই বেহুলাকে নিয়ে ভাবনা।

বেহুলা তো জানত চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মনসার দ্বন্দ্বের কথা। সে তো জানত এর আগে লখিন্দরের ছয় ভাই সাপের কামড়ে মারা গেছে। সে তো দেখছিল লোহার বাসর ঘর তৈরি হচ্ছে, পুরো নিশ্ছিদ্র হবে সেই ঘর, যাতে এক ঢোকা এবং বের হওয়ার দরজা ছাড়া আর কোনো কিছুরই প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার পথ থাকবে না। আসলেই কি বিয়েবাড়ির কোনো আবহ ছিল বেহুলার মনে নাকি ছিল অজানা আশঙ্কা। আজ এক কাল রাত্রি, এ কথা জেনেও সে বধূ বেশে সেজেছিল; সখীদের রসিকতায় মাঝেমধ্যে হয়তো হেসেও উঠেছিল। বিয়েবাড়ির সানাইয়ের সুরের মাঝে হয়তো তার কানে অবিরত বেজে গেছে হিসহিস শব্দ। কি করে উপেক্ষা করল সে তা, লখিন্দরের জন্য ভালোবাসাই কি তার সব ভয়কে জয় করে নিয়েছিল। বড় জানতে ইচ্ছে করে তখনকার বেহুলার মনকে, সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে সব জেনেও বেহুলা সব নিয়মাচার পালন করে গেছে, কেমন করে বেঁধেছিল সে তার মনকে?

এ করোনাকালে সবকিছুই তো করছি। তবে জীবনে কোনো ছন্দ খুঁজে পায় না, কোথায় যেন সুর–তাল–লয় হারিয়ে গেছে। বাইরে থেকে যখন ঘরে আসি, নিজেকে বড় আজব লাগে। একজন ভাইরাসবাহক মনে হয়। জামাকাপড় ধুয়ে, গোসল করে ধীরে ধীরে মনে হয় আমি ঘরের কেউ, এর আগে নিজেকে বড় অবাক তো লাগে। দিনের পর দিন এই দহন নিয়ে বেঁচে আছি। দাহকালে কেউ বৃষ্টির খবর শোনায় না। মনে মনে চাই একদিন বৃষ্টি এসে বলুক ভিজে যাওয়ার সময় হয়েছে! সে সময় কি আসবে! নিজেই অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি। আমার অহর্নিশ চেষ্টা আর প্রার্থনা কিছুতেই অসুস্থ হওয়া যাবে না! কিন্তু তেমন মন দিয়ে প্রার্থনাও করছি না, আকুল হয়ে ইউনুস নবীর মতো বলছি না, ‘আমাকে ক্ষমা করো আর নিশ্চয়ই আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত’। কী করছি আর কেন করছি—দুয়ে দুয়ে চার কিছুতেই মিলছে না।

আমার ছয় বছরের ছেলেকে বোধ হয় আর কিছুতেই প্রথম শ্রেণিতে ওঠানো গেল না। এই চার মাসে সে অধ্যয়ন নামক জিনিসটি ভুলতে বসেছে আর এ বিষয়ে আমার নির্লিপ্ততা চরমে ওঠায় মনে হচ্ছে ছেলেকে আবার প্লে-গ্রুপে ভর্তি করাতে হবে। তবে জীবন শিশুদের অনেক কিছুই শেখায়, যা আমরা শেখাতে পারি না। করোনাকালে কলকাতা পুলিশের গাওয়া গানগুলো সে শিখে ফেলেছে। আমাকে অবাক করে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সে ‘WE SHALL OVERCOME’ গানটা গেয়েছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ছয় বছরের শিশু অঞ্জন দত্তের ‘বেলা বোস’ গানটা গাইছে আর তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কেন বেলা মাকে বলে দিবে বিয়ে করবে না?’ প্রতি উত্তরে মা শুধুই হেসেছে।

সামনে শীতকাল। এ সময় ঠান্ডাজনিত রোগবালাই বাড়ে। এই শীতে টিকতে পারব তো? কাউকে বললে বলবে আগে গরমকাল যাক না। বড্ড বেশি ভাবি, তাই না! আমি তাদের বলতে পারি না যে, আমার পুরো পরিবারেরই অ্যালার্জির সমস্যা আছে; শীতকালটা তাই সব সময়ই বড় সাবধানে থাকি। কিন্তু এবার তো শুধু সাবধান হলেই চলবে না, কিন্তু করবটা কী? এ রকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে প্রতিদিনের দিন যাপন করি। সবকিছু স্বাভাবিক চলছে, শুধু আমি বেহুলা মন নিয়ে ঘুরি। কয়েকটা লোহার ঘর তাতে একটা ছিদ্র আর চারদিকে করোনা নামের সাপটা হিসহিস শব্দ করেই যাচ্ছে, এক্ষুনি ঘরে ঢুকে পড়বে!

*লেখক, প্রিন্সিপাল অফিসার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড