খুনি রাশেদকে ফেরত আনার আশা

বঙ্গবন্ধুর খুনি (ওপরে বাঁ থেকে) রাশেদ চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন। (নিচে বাঁ থেকে) আবদুর রশিদ, শরিফুল হক, নূর চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধুর খুনি (ওপরে বাঁ থেকে) রাশেদ চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন। (নিচে বাঁ থেকে) আবদুর রশিদ, শরিফুল হক, নূর চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
>
  • কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরাতেও আইনি প্রক্রিয়া চলমান
  • রশিদ, ডালিম ও মোসলেমউদ্দিনের অবস্থান অজানা

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের আগে থেকেই পলাতক খুনিদের মধ্যে কানাডায় এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে এ এম রাশেদ চৌধুরীর অবস্থানের বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। তাই এ দুজনকে ফেরাতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ ছিল। চলতি বছরের জুনে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের মামলার নথি তলব করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অগ্রগতি হতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনে কর্মরত একাধিক কূটনীতিক সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে বলেছেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মহলের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে মামলা পুনরায় সচল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আইনগতভাবে বিষয়টি মোকাবিলার জন্য এল এল স্কাডেন নামের একটি আইনি পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ দিয়েছে।

মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার গত ১৭ জুন ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে এ এম রাশেদ চৌধুরী–সংক্রান্ত নথি পাঠাতে ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি আগ্রহী আইন বিশেষজ্ঞদের এ নিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তাঁর কাছে মতামত পাঠাতে বলেন। ২৫ জুন রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবী দলের এক সদস্য এবং ১ জুলাই সম্ভাব্য আইন বিশেষজ্ঞের পক্ষে অন্য এক ইমিগ্রেশন আইনজীবী সময় বাড়াতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ করেন। তাঁদের ওই অনুরোধের পর মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নথি উপস্থাপনের চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করে জানা যায়, বাংলাদেশ এক দশক ধরেই রাশেদ চৌধুরীর মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের বিভিন্ন স্তরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই অ্যাটর্নি জেনারেলের এই পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে, কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারেও বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগের পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ, ব্যক্তিগত আইন সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নূর চৌধুরীর সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশকে তথ্য জানাতে সব সময় অপারগতার কথা জানিয়ে আসছিল কানাডা। এ পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনির তথ্য না দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কানাডার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে বিচারক জেমস ও’রেইলি মামলার রায়ে নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে কানাডার সরকারকে অনুরোধ জানান।

তবে গত সোমবার কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে কোনো তথ্য দেয়নি কানাডা সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা মামলা করেছি। এ ব্যাপারে আমরা সেখানকার জবাবের অপেক্ষায় রয়েছি। রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছি। তবে এ নিয়ে বিশেষ কোনো অগ্রগতি নেই। তবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের ফেরানোর ব্যাপারে আমরা এখনো আশাবাদী।’

এদিকে পলাতক অপর তিন খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

এই তিন খুনির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল সরকার সমন্বিতভাবেই সেটি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিষয়গুলো বেশ স্পষ্ট। বাকি তিন খুনি এত ঘন ঘন তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন বা করছেন তাতে করে তাঁদের অবস্থান নির্দিষ্ট করাটা বাংলাদেশের জন্য দুরূহ।’

পলাতক খুনিদের মধ্যে আবদুল মাজেদকে গত ৬ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ। এরপর ১১ এপ্রিল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অবশ্য তখন ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় যে দীর্ঘদিন ধরে নাম ও পরিচয় গোপন করে খুনি মাজেদ বিয়ে করে ভারতের কলকাতায় বসবাস করছিলেন।

বঙ্গবন্ধু মামলার রায় হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় দেন। পরে উচ্চ আদালত ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আরেক খুনি আজিজ পাশা ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান।