বঙ্গবন্ধু বিষয়ে অনন্য এক সংকলন

‘বঙ্গবন্ধু: শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে’। সম্পাদনা: মতিউর রহমান
‘বঙ্গবন্ধু: শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে’। সম্পাদনা: মতিউর রহমান

‘কফিনে পুরল ওরা, ঘাতকেরা, তাঁকে
অবহেলা আর অশ্রদ্ধায়,
অথচ মহত্ত্ব আর অমরত্ব, তাঁর দুই সহচর, তাঁর উদ্দেশে করল নিবেদন অপরূপ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঘাতকেরা সে কফিনটিকে
নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতো পাচার করতে চেয়েছিল
বিস্মৃতির বিয়াবানে আর সে কফিন
অলৌকিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল
সন্তরণশীল নৌকা হয়ে ভাসমান সবখানে।’
(গাছ, কফিন এবং নৌকা)

১৩ আগস্ট ১৯৯৬, ভোরের কাগজ–এ প্রকাশিত কবি শামসুর রাহমানের এই অসাধারণ পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ দিয়ে পাঠক যখন যাত্রা শুরু করে মতিউর রহমান সম্পাদিত এবং প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক সদ্য প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু: শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে (মার্চ ২০২০) তখন অজান্তেই এক বিষাদের বিভায় ছেয়ে যায় অন্তর। তবে ইতিহাসের বিয়োগান্ত বিদায়ের শিকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এই বই ধারণ করেছে সেই মহৎ মানবের সত্তাকে, যিনি স্বাধীনতাকে স্বাগত করতে শিখিয়েছেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীকে। তাই বিষাদই এই বইয়ের মৌল স্বর নয়, বরং আমরা দেখব বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে অজস্র বই ও সংকলনের ভিড়ে এটি স্বাতন্ত্র্য-সমুজ্জ্বল, অজানা বঙ্গবন্ধু বিষয়ে একগুচ্ছ তথ্যের উন্মোচক, অশেষ-অপার বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দুর্লভ স্মৃতির সূত্রধারক।

সংকলন সম্পর্কে ‘অনন্য বাঙালি’ শিরোনামের ছোট অথচ তাৎপর্য-গভীর ভূমিকা–কথনে সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমরা তাঁকে স্মরণ করেছি। এ দেশের প্রথম সারির ভাবুকেরা তাঁকে নিয়ে ভেবেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁদের মূল্যবান সেসব লেখা যে আমরা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম, এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। ভোরের কাগজ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেসব লেখা থেকে নির্বাচিত কিছু রচনা নিয়ে এ বই।’

দুই অধ্যায়ে বিন্যস্ত সংকলনের প্রথমে আছে ‘ভাবনায় বেদনায়’ আর দ্বিতীয়-ভাগে ‘স্মৃতিতে সতত’।

দুই ভাগে নয়টি করে আঠারোটি গদ্য এবং কবিতায় উদ্ভাসিত অনন্য, অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় বঙ্গবন্ধুর প্রাণ-প্রতিকৃতি।

‘ভাবনায় বেদনায়’ অংশে শামসুর রাহমানের পূর্বোক্ত কবিতার পাশাপাশি আছে সরদার ফজলুল করিম, সালাহউদ্দীন আহমদ, রেহমান সোবহান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এবিএম মূসা, ফারুক চৌধুরী ও মতিউর রহমানের লেখা।

২. প্রায় তিন দশক আগে সরদার ফজলুল করিমের লেখার অন্তর্বস্তু কেবল আবেগের উৎসারই ধারণ করেনি, বরং এমন কথামালায় কি আমরা ঐতিহাসিক সত্যতারও সন্ধান পাই না?

‘শেখ মুজিব স্বাভাবিকভাবে প্রয়াত হলে তাঁর দান, অবদান, শক্তি এবং সীমাবদ্ধতার যে মূল্যায়ন সম্ভব হতো এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে যে আয়ু এবং অবস্থান তিনি লাভ করতেন, তাঁর হত্যাকারীর দল তাঁকে হত্যা করে তাঁর সেই মূল্যায়নকে রুদ্ধ করে তাঁর আয়ুকে দীর্ঘতর করেছে, শেখ মুজিবের অবস্থানকে দৃঢ়তর করেছে। শেখ মুজিবের দিকে নিক্ষিপ্ত হত্যাকারীর বুলেটের আওয়াজ থেকে মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অপর এক আওয়াজ: এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’ (সেই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, পৃষ্ঠা-১৯)

রেহমান সোবহানের সংক্ষিপ্ত রচনায় আলোচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পথচলা ও বাঙালির স্বাধীনতার পথরেখার যুগলবন্দী-প্রক্রিয়া, যাদের কোনোভাবে পৃথক করা যায় না—

‘বঙ্গবন্ধু যদি এ দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও আত্মসচেতনতা না জাগাতে পারতেন (বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আগে) এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে তিনি যদি বিশ্বের সামনে প্রস্তাব উত্থাপন না করতেন, তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হতো আরও বিলম্বিত এবং দীর্ঘায়িত একটি প্রক্রিয়া।’ (বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, পৃ.-৩১)

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে কত মহার্ঘ্য-বাস্তব!-

‘ছয় দফার তিনি উদ্‌গাতা। ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব বাংলা কার্যত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের মর্যাদা পেত। কিন্তু পূর্ব বাংলার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় মর্যাদা—পূর্ণ স্বাধীনতা। সম্ভবত এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরবর্তী লক্ষ্য। নিকটবর্তী লক্ষ্য তাঁকে ফাঁকি দিয়ে জিতিয়ে গেল।’ (বঙ্গবন্ধু যেখানে বিতর্কের ঊর্ধ্বে, পৃ.-৩২)

এবিএম মূসা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর লেখার অবিকল্প শিরোনাম দিয়েছেন ‘শেখ মুজিবের বিশাল হৃদয়খানি।’

ফারুক চৌধুরীর সবিস্তার রচনায় ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতের লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড বইয়ের সূত্র ধরে তুলে ধরেছেন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত অথচ আত্মসম্মানে অটল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অমলিন মুখচ্ছবি,‘দীক্ষিত তাঁর বইতে লিখেছেন যে ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পরপরই ভারত বাংলাদেশকে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ এবং দুটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজ অনুদান হিসেবে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে শেখ মুজিবের আত্মসম্মান এতই ছিল যে তিনি এই বাহনগুলো অনুদান হিসেবে না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।’ (পৃ. ৫৬-৫৭)

মতিউর রহমানের অনুসন্ধানী লেখায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর পঁচাত্তরের খুনিদের ব্যক্তিগত পুনর্বাসন এবং তাদের হন্তারক-আদর্শের পুনরুজ্জীবন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে। ঘৃণ্য ঘাতক চক্রের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানা থাকলেও বিভিন্ন দফায় নানা নামে তাদের নাশকতামূলক অভ্যুত্থান-প্রয়াসের অনুপুঙ্খ বিবরণ অনেকেরই অজানা।

৩. ‘স্মৃতিতে সতত’ বিভাগ শুরু হয়েছে ৩ আগস্ট ১৯৯৬ ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত নির্মলেন্দু গুণের কবিতার অশ্রু-উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তিতে, ‘আগস্ট শোকের মাস, পাপমগ্ন, নির্মম-নিষ্ঠুর,

তাকে পাপ থেকে মুক্ত করো কান্নায়, কান্নায়।’

(পৃ.-৬৮) আমার দেখা মুজিব নামের ক্ষুদ্র পরিসরের স্মৃতিকথনে সুফিয়া কামাল এক বৃহৎ বাঙালির ছবি এঁকেছেন তাঁর স্বচ্ছ অবলোকনে, মমতামগ্ন উচ্চারণে, ‘ধানমন্ডি পাড়ায় মুজিবের আগে আসি আমি। তাকে গ্রেপ্তারের সময়গুলোতে তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার বউ একটা বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। এই দুর্দশার ভেতর দিয়ে মুজিবুর রহমান নেতা হয়েছে। মুজিবের ত্যাগের কোনো সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোনো পরিসীমা নেই। দেশকে যে সে কতখানি ভালোবাসত, তার পরিমাপ কোথাও নেই।’ (আমার দেখা মুজিব, পৃ.-৭১)

দেশকে, দেশের মানুষকে এই পরিমাপহীন ভালোবাসার কথা ব্যক্ত হয়েছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘এক সচেতন আমলার চোখে শেখ মুজিব’ শীর্ষক সুদীর্ঘ রচনায়।

মুহিতের পাশাপাশি আরও দুই সুপরিচিত আমলা মো. মুজিবুল হক ও সৈয়দ এ সামাদের স্মৃতিকথনে এসেছে বঙ্গবন্ধু-জীবনের কিছু দুষ্প্রাপ্য ঘটনা। ১৯৬৬ সালে লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমির শিক্ষানবিশ এস এ সামাদ তখনকার তুখোড় রাজনীতিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ছয় দফার তাৎপর্য কী?’

এর ছয় বছর পর, স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সফরে যান স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফাকে স্বাধীনতার এক দফায় সার্থক রূপায়ণকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। লাহোরের সেই প্রশ্নকারী সিএসপি শিক্ষানবিশ তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। তাঁকে দেখেই বঙ্গবন্ধুর উক্তি,

‘ও, তুমি। এখন বুঝেছ তো ছয় দফার পুরো মানে?’

এরপর এস এ সামাদের বিস্ময়-বাক্যগুলো আমাদের কাছেও বিস্ময়-জাগানিয়া, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিশ্চয়ই লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তারপরও তিনি লাহোরের এক হোটেলে আমার সঙ্গে সেই সামান্য কথোপকথনটি পরিষ্কার মনে করতে পারছেন। এত প্রখর এবং তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি।’ (একজন অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় নেতা, পৃ.-৯৩)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিশ্বস্ত ভাষ্য লিখেছেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর লেখায় বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ ফেলে বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার শপথের নিষ্ঠুর জলসা এবং নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতার চালচিত্র পরিস্ফুট হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে গণভবনের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম তাঁর জনগণ-ব্রত মনোভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছেন আপাত সামান্য কিন্তু তাৎপর্যে বিশাল কয়েকটি অভিজ্ঞতার রেখায়, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, এই ঘোড়ার ওপর বাজি ধরে বহু পরিবার ফতুর হয়ে গেছে। এটি আর চলবে না। তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে বললেন “রেসিং ট্র্যাকের ওপর সারিবদ্ধভাবে নারকেলগাছ লাগাও।” একজন কর্মকর্তা আপত্তি জানিয়ে বললেন, ফলের গাছ লাগালে লোকজন সেই ফল চুরি করে খাবে এবং এ নিয়ে মারামারি হবে। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, “জনগণের জমি, জনগণের গাছ। জনগণ যদি ফল খায়, আপনার-আমার আপত্তি কেন?’”(কালের সীমা ছাড়িয়ে, পৃ.-১০৩)

বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ সহকারী একান্ত সচিব শাহরিয়ার ইকবাল বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহের যে বিবরণ দিয়েছেন তাঁর লেখায়, সেখানে আরও অনেক তথ্যের সঙ্গে এমন তথ্যও পাওয়া যায় যে ১৪ আগস্ট দুপুরে তিনি কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের খোঁজ নেওয়ার জন্য তাঁর কন্যাদ্বয়কে নিজ অফিসে ডেকে আনেন। সবার এমন মঙ্গল-প্রত্যাশাই তো ছিল বঙ্গবন্ধু-চরিত্রের অচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। যে বৈশিষ্ট্যের কথা সংকলনের শেষ লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার কবিতা’য় বলেছেন নির্মলেন্দু গুণ,

‘আমি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলাম প্রেমাংশুর রক্ত চাই।’ এই প্রেমাংশুটা কে? আমি বলতাম প্রেমাংশু হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব করার জন্য প্রাণদানকারী আমাদের তিরিশ লাখ প্রিয়জনের প্রতীক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য সপরিবারে রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই প্রেমাংশুতে পরিণত হলেন।’ (পৃ.-১১৭)

৪. বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই সংকলন বঙ্গবন্ধু: শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু থেকে রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসের দলিল এটি, তবে মর্মগতভাবে এই সংকলন আলো-আকুল ভবিষ্যতের; সংকলক ও সম্পাদক মতিউর রহমান শুরুতেই যে যথার্থ কথাটি বলে রেখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাদের ইতিহাসের সম্পদ, তাঁর পর্যালোচনা আমাদের আত্মানুসন্ধানের মূল্যবান পথ। তাই বারবার আমরা তাঁকে স্মরণ করেছি। শুধু অতীতকে বোঝার তাগিদেই নয়, সামনের পথরেখা খুঁজে পাওয়ার জন্যও। কারণ, ইতিহাসের সব পথ ভবিষ্যতের দিকেই প্রসারিত।’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক