'করোনায় সমস্যা হয়নি, বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে'

বন্যায় জমির ধান নষ্ট হয়েছে মনোয়ারা বেগমের। জমি পরিষ্কার করে নতুন ফসল আবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়ার ক্রোকি মনিরাবাদ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
বন্যায় জমির ধান নষ্ট হয়েছে মনোয়ারা বেগমের। জমি পরিষ্কার করে নতুন ফসল আবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়ার ক্রোকি মনিরাবাদ গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ক্রোকি মনিরাবাদ গ্রামটি পদ্মা নদীর মাঝে অবস্থিত। ওই গ্রামের বাসিন্দা আসমত আলী ব্যাপারী কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চার বছর যাবৎ আসমত আলী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। সন্তানকে নিয়ে কৃষিকাজের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। বন্যায় মনোয়ারাদের সব ফসল ভেসে গেছে। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে স্বামীর চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে জোগাড় হবে, তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন মনোয়ারা।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ক্রোকি মনিরাবাদ গ্রামে মনোয়ারা বেগম ছেলে ফয়সাল ব্যাপারীকে নিয়ে বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসল খেত থেকে তুলছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায়ও আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। জমির ফসল বিক্রি করেই চলছিলাম। দুই বিঘা জমিতে আউশ ধানের আবাদ করেছিলাম। বন্যার পানি সব শেষ করে দিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কেমনে চলব আল্লাহই জানেন।’

শুধু মনোয়ারা নয়, বন্যার পানিতে এ বছর শরীয়তপুরের কয়েক হাজার কৃষকের বেঁচে থাকার অবলম্বন কৃষি ফসল তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। অনেকে ঋণ করে, ঘরে মজুত অন্য ফসল বিক্রি করে নতুন ফসলের আবাদ করেছিলেন। কৃষিকাজ করে করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে পারলেও ওই সব কৃষক বন্যা–পরবর্তী সময় কীভাবে পার করবেন, কীভাবে ঋণ শোধ করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মধ্য জুন থেকে শরীয়তপুরে নদীতীরবর্তী এলাকা তলিয়ে যেতে থাকে। এরপর পদ্মায় পানি বাড়লে বিভিন্ন গ্রামের কৃষিজমি তলিয়ে যায়। এখন বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যায় জেলায় ৪ হাজার ৫০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ধান রয়েছে ৩ হাজার ২৭০ হেক্টর, সবজি ৩৪৭ হেক্টর, পাট ৩১০ হেক্টর, অন্যান্য ফসল নষ্ট হয়েছে ১২৩ হেক্টর জমির।

বন্যায় কৃষক মতিউর রহমানের জমির সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের চরজিংকিং লাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বন্যায় কৃষক মতিউর রহমানের জমির সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের চরজিংকিং লাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ভেদরগঞ্জের কাচিকাটা ইউনিয়নের বোরকাঠি গ্রামের কৃষক আমীর হোসেন খান আউশ ধান ও পাট আবাদের জন্য স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। পাট ও ধান বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। বন্যার পানিতে তাঁর সেই আশা পূরণ হলো না। ৮০ শতাংশ জমির ধান ও ৪০ শতাংশ জমির পাট নষ্ট হয়ে গেছে।
আমীর হোসেন খান বলেন, বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পাট কাটতে পারেননি। আর ধান কাটার সময় হওয়ার আগেই সব তলিয়ে গেছে। করোনার সময়ে জমির সবজি ও বোরো ধান বিক্রি করে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা ও ঋণের ৮০ হাজার টাকা দিয়ে চাষ করা জমির সব ফসল এখন বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আল্লাহই জানেন সামনে কীভাবে পরিবার নিয়ে বাঁচবেন তিনি।

কাচিকাটার চরজিংকিং গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান সরদার জানান, সারা বছর জমিতে সবজির আবাদ করেন। কোরবানি ঈদে বিক্রি করার জন্য ৭৬ শতাংশ জমিতে করলা, শসা, বেগুনের আবাদ করেছিলেন। বিক্রি করার জন্য তা প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে নিমেষেই তা তলিয়ে সর্বনাশ হয়ে গেল। মতিউর রহমান বলেন, ‘যা বাজার দাম ছিল তাতে এ সবজি দুই লাখ টাকা বিক্রি করতে পারতাম। এখন এই ক্ষতি কীভাবে পোষাব? বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর জমি শুকিয়ে নতুন সবজির আবাদ করতে অনেক সময় লাগবে। জমি পরিষ্কার করতেও অনেক টাকা ব্যয় হবে।’

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আমীর হামজা প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর বন্যার স্থায়িত্ব ছিল বেশি। এ কারণে কৃষিতে ক্ষতিও হয়েছে। বন্যা–পরবর্তী সময়ে কৃষকের করণীয় সম্পর্কে মাঠকর্মীরা সচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করেছেন। আর প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তার জন্য ভাসমান বীজতলা, পুষ্টি বাগান প্রস্তুত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে কৃষি বিভাগ।