বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী তিন বন্ধুর দিন কাটে অভাব-অনটনে

ছবিতে বাম থেকে নির্মল কর্মকার, ইউএনও মো. তমাল হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাসেল, প্রবীর বর্মন ও অশোক পাল। ছবি: প্রথম আলো
ছবিতে বাম থেকে নির্মল কর্মকার, ইউএনও মো. তমাল হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাসেল, প্রবীর বর্মন ও অশোক পাল। ছবি: প্রথম আলো

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন তরুণ তিন বন্ধু। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যখন ভয়ে চুপ, তখন তাঁরা দেয়ালে দেয়ালে হত্যার বিচার চেয়ে পোস্টার লাগান। মিছিল করেন। এর ফলও তাঁদের ভোগ করতে হয়। প্রতিবাদের কারণে পুলিশের নির্যাতনে শিকার হন। ২৯ মাস কারাভোগ করতে হয়। একসঙ্গে কলেজে পড়া সেই তিন তরুণ বন্ধু প্রবীর বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক পাল আজ বয়স আর অভাবের ভারে নুয়ে পড়েছেন।

নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় বাজার এলাকায় থাকেন তিন বন্ধু। তাঁদের তিনজনের বয়স এখন ৬৫ বছরের কম-বেশি।তিন বন্ধুর মধ্যে প্রবীর বর্মন ভাইয়ের ইলেকট্রনিকসের দোকান দেখভাল করেন। চাঁচকৈড় বাজারে নির্মল কর্মকারের হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে। আরেক বন্ধু অশোক পালের জীবন চলছে গান শিখিয়ে। অর্থের অভাবে অশোক পাল ও প্রবীর বর্মনের অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা হচ্ছে না। চোখের সমস্যা নিয়ে চললেও টাকার অভাবে অপারেশন করাতে পারছেন না নির্মল কর্মকার।

প্রবীর বর্মনের দুই মেয়ে, এক ছেলে। তিন সন্তান উচ্চশিক্ষিত হলেও এখনো বেকার। নির্মল কর্মকারের এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়ে এমএ পাস করেছেন। এখনো বেকার। এক ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়েননি। নিজেদের দোকানটি দেখভাল করেন। আর ছোট ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। অশোক পালের দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে ব্যবস্থাপনায় অনার্স (সম্মান) পাস করেছেন।

১৫ আগস্ট উপলক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন আজ শনিবার দুপুরে প্রতিবাদকারী ওই তিন বন্ধুর বাড়িতে ছুটে যান। তাঁদের উন্নত চিকিৎসার যাবতীয় খরচ ও অশোক পালকে নির্বিঘ্ন আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আধুনিক বাদ্যযন্ত্র কিনে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। এ সময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাসেল উপস্থিত ছিলেন।

ইউএনওর এগিয়ে আসা ও মানবিক সহায়তায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ওই তিনজন বলেন, ৪৫ বছর কেটে গেছে তাঁদের খবর রাখেনি রাষ্ট্র। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা খোঁজ রাখেননি। এত বছর পর ইউএনও পাশে দাঁড়িয়েছেন, এতেই তাঁরা খুশি। গত বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপজেলা প্রশাসন সম্মাননা জানালেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা মেলেনি তাঁদের। এ আক্ষেপ রয়েই গেছে তাঁদের হৃদয়ে।

যেভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরা

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর কীভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন, সেই কথাই শোনালেন তিন বন্ধু। ১৯৭৫ সালে তিন বন্ধুই স্থানীয় বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৫ আগস্ট বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তাঁরা। ভয়ে এলাকার সবাই চুপ করে ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে তিন বন্ধু দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে দেন। পরদিন কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলও বের করেন।

মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া তিন বন্ধুকে খোঁজা শুরু করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করার জন্য হানা দেয় তাঁদের বাড়িতে। পরিস্থিতি বুঝে তিন মাসের জন্য আত্মগোপনে চলে যান তাঁরা। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার পর আবার প্রকাশ্যে আসেন তাঁরা। গর্জে ওঠে তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিন দিন পর ৬ নভেম্বর পুলিশের হাতে আটক হন তিন বন্ধু। স্বজনদের সামনেই অমানুষিক নির্যাতন করা হয় তাঁদের। থানায় নিয়ে নানা কায়দায় শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরদিন নেওয়া হয় নাটোর কারাগারে। সেখানে ১৫ দিন রাখার পর পাঠানো হয় রাজশাহী কারাগারে।

তিন মাস পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অশোক পালকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন আদালত। কিন্তু পরীক্ষার দিন কেন্দ্র থেকেই তাঁকে আবার আটক করে পুলিশ। জামিন না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার।

প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার জানালেন, রাজশাহী জেলখানায় বিচারবহির্ভূতভাবে দুই বছর আটকে রাখা হয় তাঁদের। দুই বছরের মাথায় রাজশাহী জেলা জজ আদালতে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয় তাঁদের। একই সঙ্গে ২০০ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই মাসের জেল দেওয়া হয়। জমি-গরু বিক্রি করে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেছিলেন তাঁরা।

বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জালালউদ্দিন তিন বন্ধুর ঘটনার স্মৃতিচারণ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম। ওরা তিন বন্ধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে কলেজসহ আশপাশের দেয়ালে পোস্টার লাগায়, মিছিল করে। পরে পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে।’

তিন বন্ধুর সঙ্গে ওই সময় একই কারাগারে বন্দী ছিলেন নাটোর–৪ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় আমি রাজশাহী বিভাগীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। রাজশাহী কারাগারে আমার পাশের কক্ষে ছিলেন তিন বন্ধু। তাঁদের সঙ্গে কথা হতো। তখন জানতে পেরেছিলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁরা বন্দী হয়েছেন।’

১৯৭৫ সালে গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো. ইসমাইল হোসেন শাহ। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে তিন বন্ধুর পুলিশী নির্যাতনের শিকার হওয়া এবং কারাভোগ করার ঘটনাটি তিনিসহ এলাকাবাসী জানতেন।
এদিকে ইউএনও মো. তমাল হোসেন বলেন, ‘তিন বন্ধুর দেশপ্রেম আবেগতাড়িত করেছে আমাকে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁদের সম্মাননা জানানো হয়েছিল। ব্যস্ততার কারণে তাঁদের খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয়নি। ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে তাঁদের অমানবিক জীবনযাপন ও পরিবারের সদস্যদের অসুস্থ থাকার খবর পেয়ে তাঁদের বাড়িতে যাই।’ তিন বন্ধুর কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।