পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন সহজ নয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত জুলাইয়ের শেষ দিকে ফোন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ওই মাসের শুরুতেই ঢাকায় পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। দুই দেশের সম্পর্ক অনেক বছর ধরেই শীতল যাচ্ছে। তাই হুট করে পাকিস্তানের উদ্যোগে এসব যোগাযোগ সম্প্রতি একধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীন ও নেপালের সংঘাতের সময়টাতে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এমন যোগাযোগ সন্দিহান করে তুলেছে অনেককে। চীনের প্রভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও তুলেছে কোনো কোনো মহল।

বাংলাদেশের কূটনীতিকদের মতে, হুট করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার মতো নাটকীয় কিছু ঘটেনি। তাই সম্পর্কের বিশেষ উন্নতির কথা ভাবা জল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। পরে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটে। মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে বারবার মন্তব্যের জেরে দুই দেশ একে অন্যের কূটনীতিকদের পাল্টাপাল্টি তলব করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিককে প্রত্যাহার, এরপরই বাংলাদেশের কূটনীতিককে ইসলামাবাদ থেকে অন্য দেশে বদলির মতো ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা ও ইসলামাবাদে অতীতে কাজ করেছেন এবং এখন কাজ করছেন—এমন কূটনীতিকেরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনাসহ কয়েকটি বিষয়ের সুরাহা করতে হবে পাকিস্তানকে। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসব বিষয়ে নিজেদের অতীত অবস্থান পরিবর্তনের কোনো আভাষ নেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে। আর বাংলাদেশের পক্ষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ অমীমাংসিত মৌলিক বিষয়গুলোয় ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ফোন ও দেশটির হাইকমিশনারের সৌজন্য সাক্ষাতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি খুঁজতে যাওয়া শুধুই জল্পনা।

এদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এই যোগাযোগের পর ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি হয়। বিশেষ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে ইমরান খানের ফোনালাপে চীনের প্রভাব কতটা কাজ করেছে, এ নিয়ে ভারতীয় কূটনৈতিক মহলকে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ হতে দেখা যায়। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে বলে ভারতীয় কোনো কোনো মহলের ধারণা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে চিরাচরিতভাবে চীনের নৈকট্য, হঠাৎ করে পাকিস্তানের আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এমন যোগাযোগ ভারতকে যথেষ্ট কৌতূহলী করে তোলে। ভারতের এই কৌতূহলের প্রতিফলন দেখা যায় দেশটির গণমাধ্যমে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সব দেশের সঙ্গে বন্ধুতা চাই, শত্রুতা নয়। আর কূটনীতিতে চিরদিনের জন্য বন্ধু আর চিরজীবনের শত্রু বলে কিছু নেই। কোনো দেশ কিংবা তার জনগণের এমন কিছু করা ঠিক নয়, যাতে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাইলে পাকিস্তানকে অবশ্যই একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফোন করেছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই। কাজেই সম্পর্কটা যেহেতু আছে, তাই এক দেশের নেতা অন্য দেশের নেতাকে ফোন করতেই পারেন। এতে বিশেষ কিছু হয়ে গেছে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা না–রাখা নিয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের নানা মন্তব্যের পর দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না, তা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে। মতভিন্নতাও থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান শক্তি, তাই তারা তাদের পেয়ারা বান্দাদের জন্য কাঁদছে। কিন্তু আমরা তো বিচার বন্ধ করিনি। বিচার চলছে। পাকিস্তান মন্তব্য করছে, আমরা এর জবাব দিচ্ছি। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলবে, ঝগড়াঝাঁটিও চলবে।’

হঠাৎ সক্রিয় পাকিস্তান মিশন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ফোনালাপের পরিকল্পনার বিষয়টি ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশন জানত না। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইসলামাবাদের হাইকমিশনকে ইমরান খানের ফোনের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে বলা হয়। কারণ, ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়ে ইমরান খানের ফোনের বিষয়টি জানায়।

পাকিস্তানের হাইকমিশনার রফিউজ্জামান সিদ্দিকির বিদায়ের প্রায় দুই বছর পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দেশটির নতুন হাইকমিশনার হয়ে ঢাকায় আসেন ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি। টরোন্টোয় পাকিস্তানের কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ঢাকায় এসেছেন। আর রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই প্রথম তিনি দায়িত্ব পেলেন। কানাডায় যাওয়ার আগে ইমরান আহমেদ দুই বছর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।

ইসলামাবাদের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর এবং জেদ্দায় ওআইসি সদর দপ্তরে কাজ করা ইমরান আহমেদ পাকিস্তানের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মহলটির বিশেষ আস্থাভাজন। তাই এই কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবটা বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর বিষয়কে হয়তো পাকিস্তান বিবেচনায় নিতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারিতে ঢাকায় আসার পর থেকেই পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার দেশি-বিদেশি কূটনীতিকসহ এখানকার নানা মহলে যোগাযোগ-যাতায়াতের চেষ্টা করে চলেছেন।

সম্পর্কের পথের কাঁটা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরানো, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের বিদেশি সহায়তাসহ সম্পদের হিস্যা পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়া, ফিরিয়ে নেওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫৪ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার—ঘুরেফিরে এ চার বিষয় দুই দেশের সম্পর্কের পথের কাঁটা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর পাকিস্তান এ বিষয়ে নাক গলানো শুরু করে। যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের নাক গলানোটা সম্পর্কের পথে নতুন কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে পাকিস্তানের মূল সুর খুব পরিষ্কার—এসো অতীতকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে চলি। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে অতীতের দেনা-পাওনা না চুকিয়ে সামনে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই। কাজেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির যে মৌলিক পার্থক্য, তা ঠিক আগের জায়গাতেই আটকে আছে। ফলে, সৌজন্য সাক্ষাৎ, ফোনালাপ—এ বিষয়গুলো নিতান্তই সৌজন্য ছাড়া কিছু নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা।

ইসলামাবাদ ও করাচিতে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে, অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির মতো বিষয়গুলো ছিল পাকিস্তানের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে তা কমেছে। তবে বছরের পর বছর ধরে এ পরিস্থিতি দেখতে দেখতে এগুলো তাঁদের গা–সহা হয়ে গেছে। কাজেই করোনা বিদায় নিলে বাড়ি আর অফিসের সামনে কিংবা যেখানেই যাবেন, সেখানে কেউ ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবে,Ñতা আবারও ঘটতে থাকবে। তা ছাড়া ভিসা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে কঠোর অবস্থান, তাতেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, গোয়েন্দা নজরদারি, ভিসার কড়াকড়ি ইত্যাদি বিষয় চালু রেখে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা বলাটা স্ববিরোধিতা।

দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের শেষ বা পঞ্চম বৈঠকটি ২০১০ সালের নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং এ মুহূর্তে একটি দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত এক কূটনীতিক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সালমান বশিরের সঙ্গে বৈঠকে একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়গুলো জোরের সঙ্গে তুলেছিলেন। সালমান বশির এ নিয়ে যেকোনো পর্যায়ে আলোচনা করার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে দেখা গেছে, পাকিস্তান আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাত্তর নিয়ে কি তাদের অবস্থান বদলেছে? তারা কি ক্ষমা চেয়েছে? একাত্তর নিয়ে তাদের অবস্থানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। আর দুই দেশের সম্পর্কের প্রধান বাধাই তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুই দেশের বিপরীতমুখী অবস্থান। আমি তো মনে করি, পাকিস্তানের এখনকার সরকার এ বিষয়ে আরও অনড়। কাজেই মৌলিক বিষয়ের সুরাহা ছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’