মাদক নির্মূলে লক্ষ্যহীন বিশেষ অভিযান

  • কেউ বলছে অভিযান শেষ, কেউ বলছে চলছে

  • মাদক আসছে আগের মতোই

মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে দুই বছরে ৫৮৬ জন সন্দেহভাজন মাদক কারবারি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেই অভিযান এখনো চলছে কি না, অভিযানের উদ্দেশ্য বা অর্জন কী, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো।

‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয় ২০১৮ সালের ৪ মে। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা (জিরো টলারেন্স) ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের তত্ত্বাবধানে মাদক নিয়ন্ত্রণে যুক্ত সংস্থা ও বাহিনীগুলো অভিযান শুরু করে। র‌্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ২০১৮ সালের ১৪ মে কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘আমরা চাইব, যাঁরা মাদক সেবন করেন, তাঁরা আর মাদক নেবেন না। যাঁরা ব্যবসা করেন তাঁরা মাদক বিক্রি বন্ধ করবেন। কারও কাছে মাদক থাকলে তা র‍্যাব ক্যাম্পের পাশে ফেলে যান।’

এ ঘোষণার পরদিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন দুই মাদক কারবারি। পরবর্তী ১৫ দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন ১৩২ জন। এর মধ্যে এক দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১৫ জন পর্যন্ত নিহত হন।

এ বিষয়ে জানতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামানকে তিনবার ফোন করে এবং খুদে বার্তায় প্রশ্ন পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে এই বিভাগের যুগ্ম সচিব (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ) হামিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মাস দুয়েক আগে এই পদে যোগ দিয়েছেন। বিশেষ অভিযান চলছে, এমন কোনো খবর তাঁর কাছে নেই। নিয়মিত যে অভিযান চলত, তা–ই চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন বলেন, এ বছরের শুরুর দিক থেকে অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ মাদকসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দেখভাল করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস) মাসুম রব্বানী বলেন, ১০ আগস্ট থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। সাত দিনে ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

২০১৮ সালের বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে এ অভিযান কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ অভিযান শুরু করেছে। ওই বিশেষ অভিযান বন্ধের কোনো ঘোষণা আসেনি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, তাঁরা বিশেষ অভিযানের মধ্যেই আছেন। দেশ মাদকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলতে থাকবে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ২৮৬ জন, র‌্যাবের গুলিতে ১৫৬ জন, ডিবির গুলিতে ৬৩ জন, বিজিবির গুলিতে ৭৮ জন নিহত হন।

তবু হাত বাড়ালেই মাদক

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও র‌্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষ অভিযানে মাদক নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করছে। তারপরও হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে কী করে, জানতে চাইলে সংস্থাগুলো বলছে, চাহিদা আছে বলে জোগানের কমতি নেই। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে বলছেন, মাদক নির্মূলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। দ্রুত সাফল্য দেখাতে গিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে সমাধান ধরে নিয়ে এগিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাহিনীগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো যোগাযোগ নেই, বরং অসম প্রতিযোগিতা আছে। এক ছাতার নিচে সব কটি বাহিনীকে এনে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।

সরকারিভাবে বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে ৭০ লাখ মানুষ মাদকসেবী। যদিও এই তথ্য কিসের ভিত্তিতে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

বন্দুকযুদ্ধই ভরসা

২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের নেতৃত্বে অভিযানের পরিকল্পনা হয়। তখন সিদ্ধান্ত ছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের যে পাঁচটি আলাদা তালিকা রয়েছে, সেই তালিকার তিনটিতে যাদের নাম রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে শুরুতেই অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তায়। তিন তালিকায় নাম থাকার পরও বদি নিজে ও তাঁর পরিবারের ৩০ জনই গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। অভিযান শুরুর ছয় মাসের মাথায় সিদ্ধান্তে আরও পরিবর্তন আসে। ইয়াবা কারবারে যুক্ত রাজনীতিকদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে বাকিদের ওপর কঠোর হওয়ার নির্দেশ আসে।

ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধনির্ভর ওই অভিযান শুরুর ১২ দিনের মাথায় ২০১৮ সালের ২৭ মে র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক। এর মধ্যে অবশ্য দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। গডফাদারদের আইনের আওতায় না এনে প্রধানত বাহকদের বিরুদ্ধে চালানো এ অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এমন বেশ কিছু ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে। ২০১৮ সালের ১৭ মে চট্টগ্রামের লাভলেনের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানকে র‌্যাব গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগম। এর এক দিন আগে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীর দাবি, এলাকার প্রভাবশালী এক ব্যক্তির সঙ্গে জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁকে জেল খাটতে হয়। ঘটনার দিন বায়তুল ফালাহ মসজিদে বড় ছেলের সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়ে বের হওয়ার পর র‌্যাব তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও কোতোয়ালি থানায় খুঁজে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে রাত ১২টার দিকে খবর আসে, বরিশাল পাড়ায় তাঁর স্বামীকে খুন করা হয়েছে। কেন হাবিব খুন হলেন, তার তদন্ত করে দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে র‌্যাব এলাকার সব সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে চলে যায়। সদরঘাট থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজামউদ্দিন আসকের প্রতিনিধিদলকে জানান, হাবিবের বিরুদ্ধে মাদকের পাঁচটি মামলা আছে।

একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর যশোরের ফারুক কসারী ও আজিজ কসারী বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। পরদিন দুই উপজেলায় দুই ভাইয়ের লাশ পাওয়া যায়। দুজনের কানের ওপর একটি করে গুলির জখম পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ গোলাগুলির শব্দ পাননি বলে জানান আসকের তদন্তকারী দলকে।

অভিযানের সুফল নেই কেন

মাদক নির্মূলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং মাদক নিয়ন্ত্রণে টেকসই ব্যবস্থা না নিয়ে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধকে বেছে নেওয়ার কারণে বিশেষ অভিযানের তেমন সুফল পাওয়া যায়নি। সাময়িকভাবে কোথাও কোথাও মাদক সরবরাহ কমেছে। তবে মাদক উদ্ধারের যে চিত্র, তা প্রমাণ করে কারবার চলছে, কারবারিরাও সক্রিয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হিসাবে, গত ২৮ জুলাই নাফ নদীসংলগ্ন নোয়াপাড়া থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার, ৫ আগস্ট লেদা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার, ১১ আগস্ট ২০ হাজার, ১২ আগস্ট লেদা থেকেই ২ লাখ ৩০ হাজার ও ১৫ আগস্ট দমদমিয়া থেকে ৩ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করে বিজিবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এর অর্থ হলো বাংলাদেশ থেকে ইয়াবার অর্ডার মিয়ানমারে পৌঁছাচ্ছে। ইয়াবার কারবারিদের সংখ্যা কমেছে, এমনটাও বলা যাচ্ছে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারির সংখ্যা ছিল ৩৭। ওই তালিকায় নাদিম ওরফে পচিশ ও নজু সর্দার নামে দুজন তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তালিকার এক নম্বরে থাকা মো. ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসানসহ বাকি ৩৫ জনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। অভিযান শুরুর মাস ছয়েক পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নতুন একটি তালিকা তৈরি করে। তাতে ঢাকায় ১৭৫ জনের নাম আসে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, গডফাদাররা গা ঢাকা দেওয়ায় তাঁদের অধীনরা কারবারের দায়িত্ব নিয়েছেন।

পুলিশের অন্তত চার কর্মকর্তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসততার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তবর্তী ৭০টি থানায় সৎ কর্মকর্তা নিয়োগ দিলেই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু বহুকাল ধরে থানার ওসির বদলি সদর দপ্তর থেকে হয় না। সীমান্তবর্তী এলাকার কোনো থানায় ওসির পদ ফাঁকা হলে আগ্রহী ব্যক্তি যোগাযোগ করেন রেঞ্জ উপমহাপরিদর্শকের সঙ্গে। এরপর স্থানীয় সাংসদকে দিয়ে ফোন করান। এ ধরনের বদলিতে প্রচুর টাকার লেনদেন হয়। ওসি চেয়ারে বসেই টাকা আয়ে মনোযোগী হন।

মাদকপ্রবণ এলাকার বদলিতে লেনদেনের এই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা কোনো মন্তব্য করেননি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মাদকমুক্ত করাই ছিল অভিযানের লক্ষ্য। অভিযান এখনো চলছে। যত দিন মাদক থাকবে তত দিন অভিযান চলবে। এখন পর্যন্ত তাঁরা সফল। যতগুলো অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সে তুলনায় অর্জন ভালো।

তারপরও হাত বাড়ালে মাদক পাওয়া যায় কেন? এর জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, এটা ৯০ মিনিটের খেলা নয়। চাহিদা থাকলে জোগান আসে। আর র‌্যাব মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা অনেকগুলো বাহিনীর একটি।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাদকবিষয়ক গবেষক এম এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে মাদক বিস্তারের প্রধান কারণ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় মাদকের বাজার বড়। মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। মাদক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গাটা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্যের ওপর মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, তাঁদের অনেকের নিষ্ঠা ও সততার অভাব। তাঁদের হাতে হত্যার লাইসেন্স দিয়ে দেওয়াটাও বড় উদ্বেগের বিষয়।