শোক-দুঃখের এই সব দিনরাত্রি

পোশাককর্মী মরিয়ম। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিত্সা নেন সাভারের সিআরপিতে । ফাইল ছবি
পোশাককর্মী মরিয়ম। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিত্সা নেন সাভারের সিআরপিতে । ফাইল ছবি

বগুড়া
একেকটি দুঃখগাঁথা
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার মুরারিদীঘি গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব দিনমজুর হুদা প্রামাণিক। রানা প্লাজা ধসে হারিয়েছেন ছেলে আশরাফুল ইসলামকে। এখন আশরাফুলের তিন বছর বয়সী মেয়ে আশামণিকে আগলে রেখেছেন।
হুদা প্রামাণিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশরাফুল কাজ করত রানা প্লাজার ছয় তলায়। বউ রুবিয়া খাতুন কাজ করত পাশের আরেকটি পোশাক কারখানায়। দুর্ঘটনার নয় দিন পর আশরাফুলের লাশ পেয়েছি। কিন্তু তার বউ সরকারি সাহায্যের টাকা-পয়সা তুলে উধাও হয়ে যায়। রেখে যায় আশামণিকে।’
আশামণিকে সামলাতে বড় কষ্ট হচ্ছে হুদার। বললেন, একটি বারের জন্য তাঁর পুত্রবধূ শিশু মেয়ের কোনো খোঁজ নেয়নি। প্রায় দিনই মেয়েটি ‘আব্বু, আমঞ্চু’ বলে কান্নাকাটি করে।
নন্দীগ্রামের তারাটিয়া গ্রামের রিকশাচালক হারেজ উদ্দিন হারিয়েছেন স্ত্রী রেখা বেগমকে। এখন দুই শিশু ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁর লড়াই। বড় ছেলে ইমরান সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। হারেজ বলেন, ‘প্রায়ই ইমরান মায়ের জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সারিয়াকান্দির জোড়গাছা-সোনাপুর গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আহাদ বক্স প্রামাণিকের সম্বল শুধু বসতভিটাটুকুই। ছোট ছেলে আবদুল কাদের অনেক কষ্ট করে গত বছর দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল। কলেজে ভর্তির টাকা জোগাতে রানা প্লাজায় অবস্থিত একটি কারখানায় যোগ দেয়। ওই কারখানায় আগে থেকে কাজ করতেন বড় ভাই আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ববিতা বেগম ও শাশুড়ি মেরিনা বেগম। ঘটনার ১৩ দিন পর কাদেরের প্যান্টসহ শুধু দুই পা উদ্ধার করা হয়। একটি মেশিনের নিচে ববিতার হাত চাপা পড়ে। রক্ষা পান তাঁর মা মেরিনা।
ববিতা বলেন, ‘মেরিল-প্রথম আলো থেকে দেওয়া এক লাখ টাকায় স্বামীকে একটা দোকান করে দিয়েছি। তা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলছে।’
আনোয়ার পারভেজ

 

নওগাঁ

ঋণ শোধ হয়নি এখনো
মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড় করতে দেড় বছর আগে রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানার কাজে গিয়েছিলেন জরিনা খাতুন। পুরো টাকা শোধ করার আগেই ঘটে দুর্ঘটনা। তাঁর কোমরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। দুটি পা থাকলেও হাঁটতে পারেন না। শুধু শুয়ে থেকে দিন কাটে তাঁর।
জরিনা খাতুনের (৩৫) বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ভাতকুণ্ড গ্রামে। অর্থাভাবে বর্তমানে ওই গ্রামেই বড় বোন ওয়াহিদার বাসায় উঠেছেন। সঙ্গে এসেছেন একমাত্র মেয়ে রোজিনা খাতুন ও তাঁর স্বামী।
জরিনার অল্প বয়সেই

বিয়ে হয়। সন্তান পেটে থাকতেই স্বামী তাঁকে ছেড়ে যান। মেয়ে রোজিনাকে একাই বড় করেন এবং বিয়ে দেন। বিয়েতে ৪০ হাজার টাকা যৌতুক দেওয়ার কথা ছিল। জরিনা বলেন, টাকা জমাতে অন্যের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। না পেলে না খেয়েই থেকেছেন। একটু বেশি পেলে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন খেয়েছেন। এভাবে মাত্র ৩০০ টাকায় মাস পার করেছেন। টাকা জমিয়ে যৌতুকের ৩০ হাজার টাকা শোধ করেছেন।
রানা প্লাজা ধসের দিন জরিনা আটতলায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর কোমরের ওপর একটা বিম ভেঙে পড়ে। হাতের ওপর একটি পিলার আসায় দুটি আঙুল কাটা পড়ে। কিন্তু তিনি কিছুতেই হাত সরাতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় সকাল নয়টা থেকে পড়েছিলেন। রাত একটায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ


নাটোর

‘যন্ত্রের মতো বেঁচে আছি’
রানা প্লাজা ধসে স্বামী হযরত আলীকে হারিয়েছেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর বেড়পাড়া গ্রামের রাবেয়া বেগম। এখন শারীরিক প্রতিবন্ধী একমাত্র সন্তান রাহুল আলীকে (৬) নিয়ে চলছে তাঁর সংগ্রাম।
আয়-রোজগার বলতে কিছুই নেই। শ্বশুরের পৈতৃক ভিটার একটি মাটির ঘরে মা-ছেলে বসবাস করছেন। শত কষ্টের মধ্যেও ছেলেকে স্থানীয় একটি ব্র্যাক স্কুলে এবার ভর্তি করিয়েছেন।
গত সোমবার সকাল নয়টায় বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, রাবেয়া ছেলেকে আনতে স্কুলে গেছেন। সেখানে গিয়ে কথা হয় রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যন্ত্রের মতো বেঁচে আছি। ওর (রাহুল) আব্বা আমাকে ওকে মানুষ করার সব দায়িত্ব চাপিয়ে চলে গেছেন। আমি সেই কাজটা করছি।’
তাঁর মতোই দিন কাটছে না একই উপজেলার খাকশা গ্রামের সূর্য বেগমের। মানসিক রোগী স্বামী আনিছুর রহমান ও ছেলে আবদুল মতিনকে রেখে সূর্য বেগমের বোন মদিনা বেগম মারা গেছেন অনেক আগে। নিজের সন্তানের মতো ভাগনে মতিনকে বড় করেছেন। এসএসসি পাস করিয়েছেন। তাঁদের সবার কষ্ট ঘোচাতে মতিন গিয়েছিলেন পোশাক কারখানায় চাকরি করতে। দুর্ঘটনার তিন মাস পর ডিএনএ টেস্ট করে মতিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। অনেক অনুরোধ করেও ঢাকার জুরাইনের কবরস্থান থেকে তাঁরা মতিনের লাশ আনতে পারেননি।
ভাগনেকে হারানোর পরপরই সূর্য বেগমের একমাত্র ছেলে বজ্রপাতে মারা যায়। সূর্য বেগম বলেন, ‘আমরা এখন খুব একা। রাঁধতে-বাড়তে-ঘুমাতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় দুই ছেলের মতো আমরাও নিখোঁজ হয়ে যাই।’ সূর্য বেগমের স্বামী হরফ আলী বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আমরা একটা পয়সাও পাইনি। মারা যাওয়ার পর শুনলাম, মতিন টাঙ্গাইলের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। শুনেছি, ওই মেয়েটা নাকি সরকারি কিছু টাকা পাইছে। আমরা ওর টাকা চাই না।
মুক্তার হোসেন


নীলফামারী
মৃত্যুবার্ষিকী পালনের অর্থ নেই
রানা প্লাজা ধসে নিহত নীলফামারীর ডোমার উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের জামুরবাড়ী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারের কান্না এক বছরেও থামেনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ও একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তাঁর বাবা-মা এখন দিশেহারা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছেন তাঁর মা আয়শা বেগম (৫৫)। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা

করছেন স্বামী তছির উদ্দিন (৬০)। এক দিন বাদে ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী। ছেলের কথা মনে করে মায়ের এ কান্না।
তছির উদ্দিন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরই আমাদের একমাত্র ছেলে ছিল। ওর আয়েই চলত আমাদের সংসার। এখন ওর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার মতো অবস্থাও আমাদের নেই।’
তছিরের দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে মেরিনা আক্তার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মেয়ের জামাইয়ের সহযোগিতায় কোনোমতে তাঁদের সংসার চলে।
তছির বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক লাখ টাকার চেক পেয়েছি।
এরপর মোবাইল ফোনে অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছি কিন্তু কোনো টাকাপয়সা পাইনি।’ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে বন্ধকি এক বিঘা জমি ছাড় করেছেন।
মা আয়শা বেগম বলেন, ‘আমি ক্ষতিপূরণ চাই না। তোমরা আমার ছেলেকে আনি দাও।’
মীর মাহমুদুল হাসান