স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে র্যাব নির্দোষ!

কুমিল্লার লাকসামের বিএনপির নিখোঁজ দুই নেতা সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরকে গুম করার ঘটনায় র‌্যাবের সম্পৃক্ততা পায়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে তদন্ত করে এ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে৷
অবশ্য র‌্যাবকে নির্দোষ দেখিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন নিখোঁজ দুই নেতার পরিবারের সদস্যরা৷ তাঁদের দাবি, সদ্য চাকরি হারানো র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ এ ঘটনায় জড়িত৷ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই দুজনের সন্ধান মিলবে৷
দুই পরিবার জানায়, এ পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি তাদের কারও বক্তব্য নেয়নি৷ এমনকি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যাঁকে ওই দুই নেতার সঙ্গে আটকের পর র‌্যাব পরে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে, তাঁর বক্তব্যও প্রতিবেদনে ঠাঁই পায়নি৷
পরিবার দুটির ভাষ্য, লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীরের পরিবারের অভিযোগ, অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে গত বছরের ২৭ নভেম্বর রাতে অ্যাম্বুলেন্সযোগে লাকসাম থেকে ঢাকায় আসার পথে র‌্যাবের সদস্যরা তাঁদের আটক করেন৷ এ সময় তাঁদের সঙ্গে পৌর বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিনও ছিলেন৷ জসিম উদ্দিনকে ওই রাতেই র‌্যাব অন্য আরও অনেকের সঙ্গে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে এবং সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরকে তুলে নিয়ে গুম করে৷
ওই রাতে থানায় হস্তান্তরের পর জসিম উদ্দিন ও পরদিন অ্যাম্বুলেন্স চালক সাদেক আহমেদও সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনার প্রায় একই বিবরণ দেন৷
এই দুজনের নিখোঁজ হওয়ার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তদন্তের সুপারিশ করে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে তদন্ত করে এবং ৬ মে মানবাধিকার কমিশনকে বিষয়টি অবগত করে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, ‘এটা আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা, খোঁজ নিয়ে বলব৷’
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বিএনপির এই দুই নেতাকে আটকের কথা স্বীকার করা হয়নি৷ তবে সেদিন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ‘সহিংসতার পরিকল্পনাকারী’ কয়েকজনকে আটক করার অভিযানে র‌্যাব-১১-এর অংশ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৬ নভেম্বর অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় জসিম উদ্দিন (তখনকার বিএনপির নেতা) পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন৷ গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অজ্ঞাতনামা রিকশাচালকের মৃত্যু হয়৷ জসিম উদ্দিনকে ১ নম্বর আসামি করে সেদিনই লাকসাম থানায় মামলা হয়৷ পরদিন ২৭ নভেম্বর র‌্যাব-১১-এর ডিএডি শাহজাহান আলীর নেতৃত্বে র৵াবের সদস্যরা লাকসাম থানা এলাকায় টহল দেওয়ার সময় জানতে পারেন, ফতেহপুর এলাকায় কিছু দুষ্কৃতকারী সহিংসতার জন্য সমবেত হয়েছে৷ ওই খবরের ভিত্তিতে র‌্যাবের সদস্যরা ফতেহপুর সরকারি খাদ্যগুদামের পাশে গিয়ে সেখান থেকে জসিম উদ্দিনসহ মোট নয়জনকে গ্রেপ্তার করেন৷ তাঁদের মধ্যে নিখোঁজ দুই নেতার নাম নেই৷ প্রতিবেদনের এ বিবরণকে র‌্যাবের সাজানো গল্প বলে দাবি করেন দুই নেতার স্বজনেরা৷
পরিবারের বিস্ময়: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নিখোঁজ হুমায়ুন কবীরের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জসিম উদ্দিন সব সময়ই বলেছেন, ‘আমার স্বামী ও সাইফুল ইসলামকে একসঙ্গে আটক করা হয়৷ এমনকি থানায় বসেও তা বলেছেন৷ গণমাধ্যমে বলেছেন৷ এখন পুলিশ কীভাবে তা অস্বীকার করছে?’
সাইফুল ইসলামের মেয়ে তাসনুভা ইসলাম বলেন, ‘এটা কেমন তদন্ত প্রতিবেদন হলো যে আমাদের বক্তব্য পর্যন্ত নিল না?’
হুমায়ুন কবীরের ভাই গোলাম ফারুক বলেন, ‘আজ পর্যন্ত আমাদের কেউ খোঁজ নেয়নি৷ কোনো তদন্ত কর্মকর্তাও আমাদের কাছে আসেননি৷’
জানতে চাইলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাকসাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু বকর আমাকে বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করতে বলেছে৷ আমার কাছে জানতে চাইলে পুরো ঘটনা আমি তাঁকে বলেছি৷ বলেছি, সাইফুল ও হুমায়ুন ভাই আমার সঙ্গে ছিলেন৷ তার পরও কীভাবে প্রতিবেদনে বলা হলো র‌্যাব আটক করেনি, তা আিম বুঝতে পারছি না৷’ প্রসঙ্গত, জামিনে মুক্তি পেয়ে সম্প্রতি জসিম উদ্দিন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন৷
অ্যাম্বুলেন্স চালক সাদেক আহমেদ বলেন, তাঁকেও পুলিশ বা কোনো তদন্ত কমিটি কিছু জিজ্ঞেস করেনি৷
থানার ‘দ্বিধাগ্রস্ত’ প্রতিক্রিয়া: এই প্রতিবেদক গত রোববার রাতে জানতে চাইলে লাকসাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রথমে বলেন, ‘এই তদন্তের বিষয়ে আমি কিছু জানি না৷’ পরে যখন জসিম উদ্দিনকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে লাকসাম থানারই একজন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন, তখন তিনি বলেন, ‘জি, এ ব্যাপারে আমি জানি৷’ র‌্যাব আটক করেনি, এমন তথ্য কেন দিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘সেটা তদন্ত কর্মকর্তাকেই জিজ্ঞেস করেন৷’
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি দাবি করেন, ‘আমি অনেক তদন্ত করেছি৷ আর কিছু বলতে পারব না এখন৷’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিবেদনের বিষয়ে বলেন, ‘অভিযোগ তদন্তে শিথিলতা ছিল৷ প্রয়োজনে আমরা আবারও তদন্ত করতে চিঠি দেব৷’