বিজ্ঞানে আগ্রহ সৃষ্টিতে প্রয়োজন বেসরকারি ও নাগরিক উদ্যোগ

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও নাগরিক উদ্যোগ প্রত্যাশা করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা বলেছেন, শিক্ষা বাজেটে টাকার অঙ্ক বাড়লেও বরাদ্দের হার কমছে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আলাদাভাবে কতটা গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তাঁরা।

‘বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার বিষয়টি বিশ্বজনীন বিষয়। এটা নিয়ে ভয়ের কিছু দেখছি না। তিনি মনে করেন, বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংগতি রেখে বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ ওঠা-নামা করছে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজন করে প্রথম আলো, সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। যদিও এই বৃদ্ধি বাণিজ্য ও মানবিক শাখার মতো না। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী পাস করায় মান কমার যে প্রশ্ন উঠেছে, তা ঠিক নয়। তবে এটা সত্য যে, পড়াশোনার গুণগত মান এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।

বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্রমাবনতি: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়েন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পরিচালিত গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বেশির ভাগ স্কুলে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া মাল্টিমিডিয়াগুলো খারাপ। বিজ্ঞানাগারগুলোর বেহাল অবস্থা। মাইক্রোস্কোপ খুলে দেখা হয় না। কম্পিউটার ঢেকে রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সুবিধা ও যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়, সেগুলোরও সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না।

শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা নিয়ে অন্যান্য দেশের অবস্থাও বেশি ভালো নয়। তবে ওই সব দেশ বিষয়টি মোকাবিলার নানা চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি উদ্যোগে প্রকল্প নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার বাড়লেও মান বাড়ছে না বলে সাম্প্রতিক সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার মান কোথায় আছে, তা বুঝতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে জরিপ করানো উচিত।

বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য—এ কথা উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মনজুর এলাহী বলেন, দেশের বেশির ভাগই সেবা খাত। এসব খাতে বিজ্ঞান গ্রাজুয়েটদের চাহিদা এখন আর সে রকম নয়। তিনি আরও বলেন, পোশাকশিল্প আমাদের মৌলিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই শিল্পে মধ্যম মানের ব্যবস্থাপক হিসেবে ১২ থেকে ১৫ হাজার বিদেশি কাজ করে, যা আমরা তৈরি করতে পারিনি। দক্ষ জনবলের অভাবে শিল্পের পণ্য বহুমুখীকরণ করা সম্ভব হয় না বলেও জানান এই শিল্পপতি।   

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, মানবসম্পদ নির্মাণের সেতু হচ্ছে শিক্ষা। বিনিয়োগ না করলে এই সেতু তৈরি হবে না। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করার দাবি জানান। বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

এদেশে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা বিকাশে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছাড়াও অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অন্তরায় সৃষ্টি করছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো অধ্যাপক আলী আসগর। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিষয় পছন্দ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদার্থবিজ্ঞান পড়া ৫০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁদের ৪৫ জনই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি হয়েছে। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষার্থীদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি জ্ঞানার্জনে লেলিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, এখন অনেকে ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে তারা কী হতে চায়, তা বলে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বড় হওয়ার স্বপ্ন না থাকলে তারা এগোবে কীভাবে? তাই তাদের স্বপ্ন দেখানো, বিজ্ঞান পড়তে উত্সাহী করার দায়িত্ব শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারসহ সবাইকে নিতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন বলেন, শহরে বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু গ্রামে এই আগ্রহ কমছে। বেশির ভাগ স্কুলে বিজ্ঞানাগারের অবস্থা খারাপ, শিক্ষকের সংকট আছে। যেসব শিক্ষক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অতিমাত্রায় বৈষয়িক হয়ে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।

টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ দীপক কুমার নাগ বলেন, যত বড় স্কুলের কথাই বলা হোক, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ঠিকমতো হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানে আগ্রহ কমার এটাও বড় কারণ। 

সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশন বলেন, বিজ্ঞান পড়তে গেলে অর্থ ছাড়াও বাড়তি সময় ও অধিক শ্রম দরকার। তাই প্রান্তিক থেকে যারা উঠে আসবে, তারা প্রথমে ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে কত দূর যেতে পারবে। যে মনে করে বেশি দূর যেতে পারবে না, সে তুলনামূলক সহজ ও বাজার উপযোগী ডিগ্রি নিয়ে কাজে ঢুকতে চায়।

প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের পলিসি প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান এ টি এম ফারুক-উল-ইসলাম উন্নয়ন শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা, পল্লি প্রযুক্তি কর্মসূচিতে উদ্বুদ্ধ করা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া থাকা খেলনার মাধ্যমে শিশুদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং মৃত জিনিসের সংগ্রহশালার পরিবর্তে বিজ্ঞান জাদুঘরকে আকর্ষণীয় করার ওপর গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, পদার্থ ও উচ্চতর গণিত ছাড়া বিজ্ঞান পড়ার যে চর্চা ১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল, তার জের আজও টানতে হচ্ছে। ১০০ নম্বরের সাধারণ গণিত পড়ে বিএসসি পাস করা সর্বশেষ শিক্ষক বিদায় নেবেন ২০৩০ সালে। এসব শিক্ষককে বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলার বিকল্প নেই। 

ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কর্মকর্তা মোরশেদ আলম স্কুল ক্যালেন্ডারে বিজ্ঞান মেলার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত বিজ্ঞান মেলা আয়োজন ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন উপায়ে উদ্বুদ্ধ করা, অভিভাবকদের দায়িত্বশীল হওয়া এবং শিক্ষকদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম উপস্থিত ছিলেন।