হতাশায় মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা

এক বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতি আটকে থাকায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে উপপরিদর্শক (এসআই) পদটি তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করায় এই পদে পুলিশ, না সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) পদোন্নতি দেবে, এ নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এসআইদের পরিদর্শক পদে পদোন্নতি আটকে আছে। আর পরিদর্শক থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায়।
এএসপি পদে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা ২৭ জন পুলিশ পরিদর্শক প্রথম আলোকে ক্ষোভ ও হতাশার সঙ্গে বলেন, চাকরিজীবনে অবদানের জন্য তাঁরা বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। কিন্তু যথাসময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। তঁারা জানান, ২০০৩ সালে এএসপি পদের জন্য তাঁরা তালিকাভুক্ত হন৷ কিন্তু আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় তাঁদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ পরিদর্শকদের পদোন্নতি না হওয়ায় তখন তাঁদের পদোন্নতির প্রস্তাব যায়নি। অবশেষে পদ শূন্য হলে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (এসিআর) সংগ্রহ করে পুলিশ সদর দপ্তর। এরপর ৪৪টি শূন্যপদ পূরণের জন্য ২৭ জনের নাম ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সদর দপ্তর। এরপর ছয় মাস সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়। ইতিমধ্যে ৩০তম বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তারা এএসপি পদে যোগ দেন। এরপর ৩ ডিসেম্বর তাঁদের ২৭ জনের প্রস্তাব যায় পিএসসিতে। এখনো ওই নিথ সেখানেই আটকে আছে। তাঁদের পদোন্নতি না হওয়ায় পরের তালিকায় থাকা ৮০ জনেরও পদোন্নতি হচ্ছে না। ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন অন্য সাড়ে তিন হাজার পরিদর্শকও।
বিসিএস নিয়োগবিধি, ১৯৮১ অনুযায়ী, এএসপি পদের তিন ভাগের দুই ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি বিসিএসের মাধ্যমে এবং এক ভাগ পদ পরিদর্শক থেকে বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের অন্তত ১০টি চিঠিতে দেখা গেছে, বর্তমানে মঞ্জুরীকৃত এক হাজার দুটি এএসপি পদের মধ্যে ৬৬৮টি পদে বিসিএসের মাধ্যমে এবং ৩৩৪টি পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।
পুলিশের পরিদর্শকেরা জানান, পুলিশ সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয় ঘুরে পদোন্নতির প্রস্তাব পিএসসিতে যায়, তবে সব শূন্যপদে পদোন্নতি হয় না৷ ২০১১ সালে ৮৭টি শূন্যপদের জন্য ১৫৭ জন পরিদর্শকের এসিআর পিএসসিতে পাঠায় মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৪২ জন পদোন্নতি পান৷ ২০১২ সালে ৩৩টি পদের বিপরীতে ৬৩ জনের এসিআর পাঠানো হলেও পদোন্নতি পান ১৫ জন৷ সর্বশেষ গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ২৭ জনের এসিআর পাঠানো হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর, পিএসসি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, এই প্রস্তাব পাওয়ার পর ২২ ডিসেম্বর পিএসসি থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের পাঠানো নথিতে পরিদর্শক ও এএসপিদের বর্তমান বেতন স্কেল উল্লেখ নেই। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয় তা পিএসসিকে জানায়। ১১ মার্চ পিএসসি আরেক চিঠিতে বলে, এএসপি ও পরিদর্শক, দুটিই এখন প্রথম শ্রেণির পদ। কাজেই ওই ২৭ জন কর্তকর্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই পদে মনোনীত হয়েছেন কি না। ২৯ এপ্রিল মন্ত্রণালয় এর জবাব দেয়।
পরিদর্শকদের অভিযোগ, ২০১২ সালের ৩০ জুলাই পরিদর্শক পদটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পর ৩২ জন পরিদর্শক এএসপি হয়েছেন। নতুন করে এসব প্রশ্ন তোলায় পদোন্নতি বিলম্বিত হচ্ছে৷ অবশ্য পিএসসির এ-সংক্রান্ত দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিলম্বিত করার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পিএসসি বিধি মেনেই সব করছে।
হতাশ এসআইরাও: ২০১২ সালের জুলাইতে এসআই পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং পরিদর্শক পদকে প্রথম শ্রেণির করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি পিএসসির মাধ্যমে করতে হয়৷ কিন্তু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষমতা নিজেদের কাছে রাখতে চাইলে জটিলতা তৈরি হয়। এ অবস্থায় পদোন্নতি পিএসসির মাধ্যমে করার জন্য গত বছরের ১২ জুন হাইকোর্টে রিট করেন পুলিশের দুজন উপপরিদর্শক। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। আটকে যায় পদোন্নতি। ফলে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা ৩৫০ জন পরিদর্শকের পাশাপাশি ১৪ হাজার এসআইও হতাশ হয়ে পড়েছেন।
ওই রিট আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী মো. সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আদালতকে বলেছি, প্রথম শ্রেণির পদে পদোন্নতি পিএসসির মাধ্যমেই হতে হবে। আদালত পদোন্নতির ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) সবার বক্তব্য জানতে চেয়েছেন। মামলাটি বিচারাধীন৷’
পুলিশের পরিদর্শক ও এসআইদের পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এসআই থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে যেহেতু কয়েকজন আদালতে গেছেন, এখন আদালতেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হতে হবে। তবে পদোন্নতির বিষয়টি ইতিমধ্যে এগিয়ে গেছে। খুব শিগগির ইতিবাচক কিছু হবে। এএসপি পদে পদোন্নতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিনেও পদোন্নতি না পেয়ে এসব কর্মকর্তা আসলেই হতাশ। পিএসসি থেকে এমন সব প্রশ্ন করা হচ্ছে, যেগুলো না করলেও চলে। তার পরও আমরা সেগুলোর উত্তর দিয়েছি। আরও প্রশ্ন থাকলে সেগুলোরও উত্তর দেব। কিন্তু এই দীর্ঘসূত্রতায় কর্মকর্তাদের হতাশা বাড়ছে। আমরা চাই বিষয়টির দ্রুত সুরাহা হোক৷’