দুই সাংসদের দ্বন্দ্ব, ছাত্রলীগ পদাতিক বাহিনী

তালুকদার আবদুল খালেক, মিজানুর রহমান
তালুকদার আবদুল খালেক, মিজানুর রহমান

সরকারি দলের দুই সাংসদ ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখানে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। গত তিন মাসে অন্তত ছয় দফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে তারা। এ ছাড়া দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা তো রয়েছেই৷
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক ও সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের দাপট প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ছাত্রলীগের দুটি অংশ অনেকটা পদাতিক বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তালুকদার আবদুল খালেক বাগেরহাট-৩ আসনের (মংলা-রামপাল) ও মিজানুর রহমান খুলনা-২ (সদর) আসনের সাংসদ।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে খুলনা শহরে দাপট প্রতিষ্ঠার জন্য আযম খান কমার্স কলেজ ও এম এম সিটি কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শহরের কেন্দ্রস্থলে। আবার খুলনা শহরে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও থাকে এই দুই কলেজের সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হাতে। এ ছাড়া কলেজের ভর্তি-বাণিজ্য, নগরে বিভিন্ন উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ-বাণিজ্য তো রয়েছেই।
এর আগে ছাত্রলীগের খুলনা মহানগর ও উপজেলা কমিটির অন্তত ১১ জন নেতার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠেছিল সংগঠনের ভেতর থেকেই। এ নিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷
মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে খুলনার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ ছিল তালুকদার আবদুল খালেকের। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সদর আসনের সাংসদ হওয়ার পর মিজানুর রহমান ছাত্রলীগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। এর পর থেকে ছাত্রলীগের দুই অংশের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়৷ এর মধ্যে সিটি কলেজ মিজানের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এখন তাঁরা কমার্স কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় আছেন৷ অপরদিকে তালুকদার খালেকের অনুসারীরা এখানে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া।
তবে তালুকদার আবদুল খালেক দাবি করেন, কলেজগুলোতে ভর্তি শুরু হয়েছে। আর ভর্তি থেকে বাণিজ্য করার জন্য কিছু সন্ত্রাসী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এ কারণে সংঘর্ষ হচ্ছে৷ এরা কোনো দলের বা নেতার লোক নয়৷ তবে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘সংঘর্ষে জড়িত ব্যক্তিরা যদি আমার বা মিজান ভাইয়ের পক্ষেরও হয়, তবুও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আর মিজানুর রহমান দাবি করেন, তাঁর ও তালুকদার খালেকের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এসব সংঘর্ষ সম্পূর্ণ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
অবশ্য এর মধ্যে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তার পরও মারামারি বন্ধ হয়নি৷ সর্বশেষ সংঘর্ষ হয়েছে গত বুধবার। এ দিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কর্মাস কলেজে ছাত্রলীগের দুই অংশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে নগর ছাত্রলীগের সহসভাপতিসহ সবুজ হাজরা ও কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী মো. রিংকু ফরাজী মারাত্মক আহত হন। রিংকু এখন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷
আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে প্রথম সংঘর্ষ হয় গত ২১ ফেব্রুয়ারি নগরের শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে। এর জের ধরে পরদিন কমার্স কলেজে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান, নগর কমিটির নেতা সালাউদ্দিন, জয়দেব, শাকিল, শাফিন, রবিউল, রায়হানসহ ১৫ নেতা-কর্মী আহত হন।
এ ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগর শাখার সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপর ৫ মার্চ কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের আস্তানা হিসেবে পরিচিত রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি কক্ষ থেকে পিস্তল, গুলি, ধারালো অস্ত্রসহ মাদক সেবনের বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ঘটনায় নগর ছাত্রলীগের সভাপতি দেবদুলাল বাড়ৈ (বাপ্পি), সহসভাপতি সবুজ হাজরা, অর্থ সম্পাদক সজল বাড়ৈ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনের (মানিক) বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা করে পুলিশ।
এরপর ১৭ মার্চ ছাত্রলীগের দুই অংশ কমার্স কলেজের ক্যাম্পাসে পৃথকভাবে মহড়া দেয় ও ২৫ এপ্রিল তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় কলেজের সামনে আওয়ামী লীগের নেতা সুজন আহমেদের ব্যবসায়িক কার্যালয়সহ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর হয়। তারপর ১৯ মে সংঘর্ষ হয় সিটি কলেজে।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এসব সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, বিবদমান এই অংশের মধ্যে মিজানের অনুসারী অংশের নেতৃত্বে আছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান (রাসেল) ও মহানগর কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম হোসেনুজ্জামান। আর খালেকের অনুসারীদের নেতৃত্বে আছেন মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি দেবদুলাল বাড়ৈ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুজন আহমেদ।
দেবদুলাল বাড়ৈ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা কিছু অছাত্রকে ছাত্রলীগে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। যাদের অস্তিত্ব কিছুদিন আগেও ছিল না। আমি ও সুজন ১০-১২ বছর ধরে নগরের কলেজগুলোতে বিচরণ করে বেড়াচ্ছি। এখন যদি নতুন কোনো ছাত্রলীগ এসব কলেজের দখল নিতে চায় তা হলে তো খুনাখুনি হবেই।’
আর সুজন আহমেদ সাংসদ মিজানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এক সাংসদের ইন্ধনে কিছু অছাত্র ভর্তি-বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তার করতে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
তবে সাংসদ মিজানের অনুসারী আসাদুজ্জামান সাম্প্রতিক হানাহানির জন্য দেবদুলাল বাড়ৈ ও মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেনকে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেন, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মাদক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আর সাধারণ সম্পাদক সভা-সমাবেশে আসেন না। ছাত্রলীগের যাঁরা এর প্রতিবাদ করেন তিনি তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাংসদ মিজানুর রহমানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আছে। তবে এর সঙ্গে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বের সম্পর্ক নেই।