কাজে আসেনি তিন সেতু

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্রামীণ ছোট ছোট সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ কর্মসূচির আওতায় ২০১১-১২ ও ২০০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মিত তিনটি সেতু কাজে লাগছে না ফারুয়া ইউনিয়নবাসীর। সেতু নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সেতু তিনটি বছর না ঘুরতেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিলাইছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) তত্ত্বাবধানে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
গত রোববার সরেজমিনে ওই তিনটি সেতু ঘুরে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন জেলার অন্যতম দুর্গম ইউনিয়ন। জেলা বা উপজেলার সঙ্গে ফারুয়া ইউনিয়নে এখনো সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। স্থানীয়ভাবে যোগাযোগে পার হতে হয় প্রচুর খাল বা পাহাড়ি ছড়া।
সেতু তিনটি স্থানীয় মানুষের কাজে আসছে না বলে উল্লেখ করে ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তেজেন্দ্র লাল তঞ্চঙ্গ্যা ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রত্নাংকুর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা উপজেলা পরিষদে স্থানীয় চাহিদার কথা জানাই। তারপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পিআইওর তত্ত্বাবধানে সবকিছু হয়। বাস্তবায়নে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। এ ছাড়া ভরাট করা মাটিতে নির্মাণত্রুটির কারণে সেতুগুলো প্রথম থেকেই ব্যবহারের অযোগ্য বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ সালে ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৫২৬ টাকা ব্যয়ে গোয়াইনছড়ি ছড়ার ওপর নির্মিত ৪০ ফুট দীর্ঘ সেতুটির একটি অংশ ডেবে গিয়ে হেলে পড়েছে। মাটি সরে গেছে সেতুর দুই দিক থেকে।
সেতুটির এ অবস্থা সম্পর্কে গোয়াইনছড়ি গ্রামের প্রধান কার্বারি হুক্কে মনি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘সেতু নির্মাণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। তবে সেতুটি সঠিক স্থানে নির্মাণ করা হয়নি।’
২০১১-১২ অর্থবছরে এগুজ্জেছড়ি ফারুয়া বাজার রাস্তার গণিছড়ার ওপর ২২ লাখের বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩৩ ফুট দীর্ঘ সেতুটি বছর না ঘুরতেই মাঝখানে ডেবে যায়। সেতুটি নির্মাণের পর সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় কেউ কোনো দিন সেতু পার হয়নি বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয় এগুজ্জেছড়ি গ্রামের স্বপ্নরাণী তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫) সেতুর পাশের বাঁশের সাঁকো পার হওয়ার সময় বলেন, ‘আমি প্রতিদিন এই পথে আসা-যাওয়া করি কিন্তু কোনো দিন সেতুতে আমার পা পড়েনি।’
পাশের বাঙালি পাড়ার বাসিন্দা আবদুর রহিম (৩৬) বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণে শুধু টাকা খরচ করা হয়েছে। কারও কোনো উপকারে আসেনি।’
একই অর্থবছরে ওরাছড়ি ফারুয়া বাজার রাস্তার মরা গোয়াইনছড়ি ছড়ার ওপর ২১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৫৪ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ৪৯ ফুট দীর্ঘ সেতু। সেতুর দুই দিক জঙ্গলে ঢাকা। দুই দিকের সংযোগ রাস্তার মাটি সরে গিয়ে অনেক ওপরে উঠে গেছে সেতুর পাটাতন। তা ছাড়া সেতুটির সব স্থানেই ফাটল দেখা গেছে।
রাঙামাটি জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও) বিশ্বনাথ মজুমদার বলেন, ‘এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় কাজ খুবই খারাপ হয়েছে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্রামীণ ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মাণ কর্মসূচির দরপত্রে সেতু নির্মাণে সিলেটের পাথর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই সব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় পাথর দিয়ে। এ ছাড়া বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণেও ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। যখন বালু, সিমেন্ট, পাথর মিশ্রণের কাজ হয়েছে তখন পিআইও বা তাঁর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বলে মনে হয় না।’
বিলাইছড়ি উপজেলা পিআইও মনিরুল ইসলাম সেতু নির্মাণে স্থানীয় পাথর ব্যবহারের সত্যতা স্বীকার করেন। তবে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে স্থানীয় পরীক্ষাগারে পাথরের মান পরীক্ষার পর ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া দুর্গম এলাকা হওয়ায় সব সময় সেতু নির্মাণ তদারকি করা সম্ভব হয় না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সেতু কোথায় নির্মিত হবে তা নির্ধারণ করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। গোয়াইনছড়ি ছড়ার সেতুর সংযোগ সড়কের মাটি সরে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের কাছে জামানত হিসেবে থাকা ঠিকাদারের তিন লাখ টাকা দিয়ে সরে যাওয়া মাটি ভরাট করা হয়েছে। তবে ডেবে যাওয়া অংশ আর ঠিক করা সম্ভব হবে কি না সে ব্যাপারে ইউএনও কোনো কিছু বলেননি।’ এ ছাড়া অপর দুটি সেতুতে আর কোনো কিছু করা সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।