রেলক্রসিংগুলো যেন মরণফাঁদ

অরক্ষিত রেলগেট। যখন-তখন ঘটে দুর্ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের পাগলার ভাণ্ডারি দোকান রেলগেট এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা l ছবি: হাসান রাজা
অরক্ষিত রেলগেট। যখন-তখন ঘটে দুর্ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের পাগলার ভাণ্ডারি দোকান রেলগেট এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা l ছবি: হাসান রাজা

সারা দেশে আড়াই হাজার রেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৮৫ শতাংশই অরক্ষিত। এগুলোতে প্রতিবন্ধক নেই। এমনকি হাতের ইশারায় যানবাহন থামানোর জন্য নেই কোনো প্রহরী। দুই হাজারের অধিক অরক্ষিত রেলক্রসিং যেন মরণফাঁদ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সারা দেশে এখন রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা দুই হাজার ৫৪১। এর মধ্যে মাত্র ৩৭১টি রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবন্ধক ও প্রহরী (গেটম্যান) আছে। বাকি দুই হাজার ১৭০টি রেলক্রসিং অরক্ষিত, সব সময় খোলা থাকে। কিছু ক্রসিংয়ে নামমাত্র প্রতিবন্ধক থাকলেও সেগুলো দেখার মতো কেউ নেই।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেলক্রসিংগুলোকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছে। এগুলো হলো স্বীকৃত ও অস্বীকৃত বা অবৈধ। স্বীকৃত ক্রসিং এক হাজার ৪১৩টি আর অস্বীকৃত এক হাজার ১২৮। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক তৈরির সময় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে যে ক্রসিংয়ের সৃষ্টি করেছে, সেটাকেই অস্বীকৃত বলা হয়। অবশ্য রেলওয়ের স্বীকৃত রেলক্রসিংয়েরও ৭৪ শতাংশের কোনো প্রহরী নেই।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সেরেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এসব সাইনবোর্ডের ভাষা অনেকটা এ রকম: ‘এখানে কোনো গেইটম্যান নাই। দেখিয়া-শুনিয়া চলিবেন’।
কিছু সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে: ‘এখানে কোনো গেইটম্যান নাই। পথচারী ও সকল যানবাহন চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার করিবেন এবং যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে নিজেই বাধ্য থাকিবেন’।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথেও এ ধরনের লেখাসংবলিত সাইনবোর্ড দেখা যায়। অথচ এই পথে প্রতিদিন ২৮টি ট্রেন চলাচল করে। কর্মদিবসে দিনে প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর ট্রেন চলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে। এই পথের সায়েদাবাদ ও গেন্ডারিয়ার রেলক্রসিংয়ে গত দুই বছরে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত সাতজন মারা যান। গতকাল শুক্রবারও মালিবাগে ট্রেনের ধাক্কায় কয়েকজন কার আরোহী আহত হন।
এ ছাড়া গতকাল ঝিনাইদহের একটি রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী বাসের ১১ জন মারা যান। রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজশাহী থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলপথের অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যান ১৫ জন। আহত হন ৫০ জনের বেশি।
দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যেসব মামলা করেছে, সবগুলোতেই চালককে দায়ী করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মোটরযান অধ্যাদেশে বলা আছে, গাড়ি চালানোর সময় রেলক্রসিংয়ে এসে চালককে থামতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। এটা করলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই। চালক এটা মানেননি বলেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘটনায় মৃত চালকও আসামি হয়েছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সারা দেশে ৩৭১টি রেলক্রসিংয়ে প্রহরী আছেন। এঁদের অন্তত ২৫০ জনই চুক্তিভিত্তিক। অনেকে দৈনিকভিত্তিক মজুরিতে কাজ করেন। তাঁদের প্রশিক্ষণও নেই। ২০০৫ সালের পর থেকে প্রহরী নিয়োগ বন্ধ আছে। সম্প্রতি নিয়োগের উদ্যোগ নিলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা মামলা করে তা আটকে দেন।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে। কমিটির অধিকাংশ প্রতিবেদনেই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে অবৈধ রেলক্রসিংয়ের কথা উল্লেখ করে দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়া হয়। অবৈধ রেলক্রসিংয়ের নামে যে মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, সেটির নিরাপত্তা বিধানে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।
জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বৈধ-অবৈধ ভেবে আসলে কাজ হবে না। বেশি যানবাহন চলাচল করে—এমন প্রায় ৭০০ রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক ও প্রহরী নিয়োগের জন্য তিনি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে।
অস্বীকৃত ক্রসিং কী: রেলক্রসিং নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে রশি টানাটানি একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। রেলওয়ে যেসব রেলক্রসিংকে অবৈধ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দায় সারে, সেসব রেলক্রসিংয়ের সড়ক নির্মাতা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), স্থানীয় সরকার বিভাগ কিংবা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
রেলওয়ের আইনে রেললাইন দিয়ে সড়ক করতে হলে আগে আবেদন করতে হয়। এরপর গেটম্যানের আট বছরের বেতন, অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের অর্থ দিতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা হচ্ছে না। এ ধরনের ক্রসিংগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে রেলওয়ে আর কোনো দায় নেয় না। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। চলতি বছরের শুরুতে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষ হয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, অবৈধ এক হাজার ১২৮টি গেটের মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরেরই সবচেয়ে বেশি, ৪৬০টি। এরপর ইউনিয়ন পরিষদের ৫৪৮টি। এ ছাড়া অবৈধ গেট রয়েছে সওজের, পৌরসভা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের, বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষের। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ব্যক্তিগত কলকারখানার সামনে রাস্তা করে ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং তৈরি হয়েছে অন্তত ১৭ স্থানে।
প্রকল্প আছে, কাজ কম: রেলওয়ে সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথ খুবই ব্যস্ত। সারা দিনই ট্রেন চলে। এই পথে ৩৬টি রেলক্রসিং রয়েছে। প্রায় দুই যুগ আগে গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিংয়ে উড়ালপথ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাজ হয়েছে সামান্যই।
ঢাকা নগর পরিবহন প্রকল্পের অধীনে প্রথম উড়ালপথ হয় মহাখালীতে। এরপর খিলগাঁও, স্টাফরোড, টঙ্গী ও কুড়িল উড়ালপথ করা হয়। জুরাইন-ফতুল্লার মধ্যে উড়ালপথ করার প্রকল্প নিয়ে আর এগোয়নি। মালিবাগ-মগবাজার ও এফডিসির কাজ চলছে। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া ও গেন্ডারিয়ায় উড়ালপথের বিষয়ে কারোরই আগ্রহ নেই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ৭০৩টি রেলক্রসিং উন্নয়নে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৯০ কোটি টাকার ওই প্রকল্প এখনো রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৭০৩টি রেলক্রসিংয়ে লোকবল নিয়োগ, গেট সংযোজন এবং সংকেতব্যবস্থা চালু করার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প এগোচ্ছে না।

সারা দেশে রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা
২৫৪১
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবন্ধক ও প্রহরী আছে এমন রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা
৩৭১
অরক্ষিত বা সব সময় খোলা থাকে এমন রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা
২১৭০