'এত খাটলাম, এত প্রোডাকশন হলো, তবে বেতন পাই না কেন?'

বেলা সাড়ে ১১টা। রাজধানীর উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেটে ঢোকার মুখে রায়ট কার আর জলকামান আড়াআড়ি করে রাখা। পাশেই তোবা গ্রুপের অনশনরত শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য বাক্স বসেছে। শ্রমিক নেতাদের ভাষণ চলছে। এরই মধ্যে হঠাত্ হুড়োহুড়ি। গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা এক শ্রমিককে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। ভালো করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই তিনি বেঁচে আছেন কি না।

তোবা গ্রুপের অধীন বুগসান গার্মেন্টস, তোবা ফ্যাশন, তোবা টেক্সটাইল, তাইফ ডিজাইন ও মিতা ডিজাইনের শ্রমিকদের আন্দোলন আজ রোববার সপ্তম দিনে গড়াল। অনশনরত শ্রমিকেরা জানেন না, এ আন্দোলনের শেষ কোথায়। আদৌ তাঁরা তাঁদের বকেয়া বেতন পাবেন কি না! এঁদের বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে, বাকি পড়েছে মুদি দোকানে।

তোবা গ্রুপের আন্দোলনরত শ্রমিকদের চিকিত্সাসেবা দিচ্ছে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। এ হাসপাতালের কর্মকর্তা রিনা পন্ডিত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পাঁচজন শ্রমিককে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত স্যালাইন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। আজ শ্রমিকদের অবস্থা সংকটাপন্ন। কারও কারও খিঁচুনি হচ্ছে, কেউ বমি করছেন।’

অসুস্থ হয়ে পড়া শ্রমিকের সংখ্যা এখন শতাধিক। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামে কেউ বলতে পারছে না।

আজ হোসেন মার্কেটের নিচে ৬০ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। কর্তব্যরত একজন পুলিশ সদস্য আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাঁরা আছেন। জলকামান আর রায়ট কারও একই কারণে।

আয়রন করার টেবিলে একটা ডুরে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন শাহিদা নামের এক কর্মী। টানা অনশনে কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়েছেন। একটা প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি তাঁর কাছ থেকে। তাঁকে শুশ্রূষা করছিলেন সহকর্মী ও প্রতিবেশী মোর্শেদা বেগম। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে তোবা গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। গোটা পরিবার পথে বসতে চলেছে।

অনশনরত এক শ্রমিক চার বছর ধরে কাজ করছেন তোবা গ্রুপের কারখানায়। জানালেন, টাকা-পয়সা না দেওয়ার টালবাহানা চলছিল বেশ আগে থেকেই। তাজরীন ফ্যাশনস পুড়ে যাওয়ায় মালিক পথের ফকির হয়েছেন—এমন একটা প্রচার ছিল। এও বলা হয়েছিল, মালিক মুক্তি পেলে বেতন হবে। এই আশ্বাসে তাঁরা তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের মুক্তির দাবিতে মিছিলও করেছেন। চারবার বিজিএমইএতে গেছেন। স্থানীয় থানায় গেছেন। প্রশাসনের লোকজন দেলোয়ারের স্থাবর-অস্থাবর বিক্রি করে পাওনা মেটানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল বলে তাঁর দাবি। শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এই শ্রমিক বছরে একবার তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে দেখতে বরিশালে যান। কারও জন্য কিছু কেনাকাটা করতে না পারলেও ছেলেটির জন্য একটা নতুন পোশাক কিনেছিলেন। টাকার অভাবে পোশাকটা পাঠানো হয়নি। কবে এই অচলাবস্থা কাটবে, কবে ছেলেকে দেখতে পাবেন তিনি জানেন না।

হোসেন মার্কেটের সিঁড়ির লাগোয়া দেয়ালে নানা ধরনের পোস্টার ঝোলানো। শ্রমিকদের মনে অনেক প্রশ্ন। পোস্টারে লেখা ‘এত খাটলাম, এত প্রোডাকশন হলো, তবে বেতন পাই না কেন?’, ‘সরকার কার, শ্রমিকের না বিজিএমইএর’। হাতে আঁঁকা পোস্টারে তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের ছবি টানানো। মালিকের ঈদ আর শ্রমিকের ঈদের পার্থক্য দেখানো হয়েছে ছবি এঁকে। বাইরের লোকজনের প্রবেশ নিষেধ লেখা থাকলেও আছে উত্সুক জনতার ভিড়।

কারখানার ভেতরে গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন শ্রমিকেরা, কেউ স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ শ্রমিক সুফিয়া এক কোনে বসেছিলেন। ভোলা থেকে আসা এই নারীর টাকায় পেট চলে বাবা-মা আর ছোট দুটি ভাইবোনের। তিনি বললেন, বাড়িওয়ালার ভাড়া বাকি পড়েছে। টাকার বিনিময়ে বাড়িওয়ালার পরিবারের সঙ্গেই খেতেন। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা, এখন খাওয়াও বন্ধ।

শ্রমিকেরা কবে বকেয়া বেতন-বোনাস পাবেন—এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তোবা গ্রুপের কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।