'পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়'

যা ছিল ধ্বংসস্তূপ, তা থেকেই তৈরি হচ্ছে স্মৃতিভাস্কর্য। ২০১১ সালে মানিকগঞ্জের জোকায় বাসের ধাক্কায় পিষ্ট সেই মাইক্রোবাসটি নিয়েই এ ভাস্কর্য তৈরি করছেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। দুমড়ানো-মোচড়ানো সিটগুলো ইতিমধ্যে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় পেয়েছে অনন্য মাত্রা। ওই মর্মন্তুদ ঘটনায় অকালে নিভে যায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণপ্রদীপ l ছবি: প্রথম আলো
যা ছিল ধ্বংসস্তূপ, তা থেকেই তৈরি হচ্ছে স্মৃতিভাস্কর্য। ২০১১ সালে মানিকগঞ্জের জোকায় বাসের ধাক্কায় পিষ্ট সেই মাইক্রোবাসটি নিয়েই এ ভাস্কর্য তৈরি করছেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। দুমড়ানো-মোচড়ানো সিটগুলো ইতিমধ্যে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় পেয়েছে অনন্য মাত্রা। ওই মর্মন্তুদ ঘটনায় অকালে নিভে যায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণপ্রদীপ l ছবি: প্রথম আলো

সবুজ ঘাসের ওপর মুখোমুখি বসে আছে গাড়িটির দোমড়ানো-মোচড়ানো আসনগুলো। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ
পাঁচজনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তের স্মারক। এসব আসনকে হঠাৎ মানুষ বলে ভ্রম হয়।
যা ছিল ধ্বংসস্তূপ, তা থেকেই তৈরি হচ্ছে স্মৃতিভাস্কর্য। বন্ধুত্ব ও বড় অকালে বন্ধু হারানোর বেদনা মিলেমিশে হয়ে উঠছে
ইস্পাত আর ফাইবার কাচের এই স্মৃতিনির্মাণ। গোড়ার কাজটি চলছে ঢাকা শহরে নিভৃত এক চত্বরে।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ভোরে কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারণের স্থান নির্বাচন করতে মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ নয়জন। ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকায় তাঁদের
মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিয়ে পিষে ফেলে উল্টো দিক থেকে আসা একটি বাস। সেখানেই মারা যান পাঁচজন। তারেক,
মিশুক, মাটির ঘর নির্মাণকর্মী জামাল হোসেন, গাড়িচালক মুস্তাফিজুর রহমান ও কর্মী মোতাহার হোসেন ওরফে ওয়াসিম।
আহত হন তারেকের স্ত্রী ও চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী দিলারা বেগম জলি।
একমাত্র অক্ষত থাকেন কাগজের ফুল-এর সহকারী পরিচালক মনিস রফিক।
ঢাকা মেট্রো চ-১৩-০৩০২ নম্বরের সেই গাড়ি থেকে স্মৃতিভাস্কর্যটি নির্মাণ করছেন ঢালী আল মামুন। মৃত্যুর সঙ্গে অনেক দিন
টানা লড়াই করে ফিরে এসেছেন। দুর্ঘটনার দুই বছর পার হওয়ার পর একদিন পরিত্যক্ত গাড়িটির ভেতরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী
প্রথম ঢোকেন। রক্তের ধূসর ছোপ আর পড়ে থাকা আরও কিছু চিহ্ন বড় জীবন্ত হয়ে ধাক্কা দিয়েছিল সেদিন। বিষাদে আচ্ছন্ন
গলায় শিল্পী বলেন, সব কাজ নিয়েই পরামর্শ করতেন এ দুই বন্ধুর সঙ্গে—‘এখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। ওদের জিজ্ঞেস
করি, ঠিক হচ্ছে তো কাজটা?’

বন্ধু হারানোর শেষ মুহূর্তের স্মারকে শিল্পীর ছোঁয়া l প্রথম আলো
বন্ধু হারানোর শেষ মুহূর্তের স্মারকে শিল্পীর ছোঁয়া l প্রথম আলো

‘তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মৃতিভাস্কর্য’টি স্থাপিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলসংলগ্ন সড়কদ্বীপে। এটা
পরিকল্পিত হয়েছে একই সঙ্গে একধরনের স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর হিসেবে। চলচ্চিত্র নিয়ে বসবাস করতেন যাঁরা,
চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়াতেই যাঁদের মৃত্যু, তাঁদের স্মৃতিভাস্কর্যেও তাই চলচ্চিত্র থাকবে—সেটাই স্বাভাবিক। তারেক মাসুদ তাঁর
চারপাশের জীবন দিয়ে ইতিহাসকে ধারণ করতেন। প্রামাণ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্রের একধরনের মিশেল ছিল তাঁর ছবিতে। সেই
প্রতিফলন থাকবে এখানেও।
তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নেতৃত্বে নির্মীয়মাণ এই স্মৃতিভাস্কর্যের উদ্বোধন হবে ২৬ আগস্ট, জানালেন ক্যাথরিন
মাসুদ।
স্থাপনাটির তিনটি অংশ থাকবে। প্রথম অংশে থাকবে দুর্ঘটনার স্মারক গাড়িটির মূল কাঠামো। সেটির কম ক্ষতিগ্রস্ত পাশটিতে
ঝুলে থেকে পাঁচটি হাতের অবয়ব হারিয়ে যাওয়া জীবনগুলোর কথা বলবে। ভাস্কর্যের দ্বিতীয় অংশ গড়বে গাড়ির ভেতর থেকে
বের করে আনা আসনগুলো। সেগুলো স্থাপিত হবে মাটির কয়েক ফুট ওপরে, যেন বা ভাসমান। তৃতীয় অংশে গাড়ির বিভিন্ন
যন্ত্রাংশ মনে করিয়ে দেবে ছিন্নভিন্ন জীবনের কথা। আর এভাবেই দুর্ঘটনার প্রামাণ্য তথ্যগুলো একটি কাহিনি হয়ে যাবে।
গাড়িটি বসানো হবে কালো স্ফটিক পাথরের ভিতের ওপর। কালোর বিপরীতে গাড়ি আর আসনগুলো হবে সাদা রঙের।
ফুটে উঠবে শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশে ভাস্কর্যের আন্তর্জাতিক ভাষা। সড়কদ্বীপের ল্যান্ডস্কেপ করেছেন স্থপতি সালাউদ্দিন
আহমেদ। তিনি বললেন, এমন মানুষদের এভাবে চলে যাওয়া জাতির জন্য যে বিশাল ক্ষতি, সে হারানোর বোধটি তৈরি
করাও স্মৃতি ভাস্কর্যের একটি উদ্দেশ্য।
ছোট ছোট ধাপ পেরিয়ে প্রবেশ করতে হবে ভাস্কর্যের মূল চত্বরে। চলন-প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকবে র্যাম্প।
ভাস্কর্যের তিনটি অংশে শিল্পী বসিয়ে দেবেন তিনটি ময়না পাখি। কালো স্ফটিকের ভিতে খচিত থাকবে মাটির ময়না
চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত তারেকের গান ‘পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়’। খচিত থাকবে পথিক নবীর গাওয়া মিশুকের প্রিয়
গানটিও—‘মানুষ আমি, আমার কেন পাখির মতো মন?’