'নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি'

রাঙামাটিতে উদ্ধার হওয়া সেই পাঁচজন। ছবি : সুপ্রিয় চাকমা, রাঙামাটি।
রাঙামাটিতে উদ্ধার হওয়া সেই পাঁচজন। ছবি : সুপ্রিয় চাকমা, রাঙামাটি।

‘আমরা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। এটা সত্যি অভাবনীয়। এখন বাবা-মাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে রোজা রেখে ঈদ করতে পারব। এজন্য খোদা তাআলার প্রতি অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ যাঁরা আমাদের মুক্তির ব্যাপারে সব সময় চেষ্টা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ ১৭ দিন পর আজ শুক্রবার ভোরে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে এভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন বি টেকনোলজির অপহূত প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত মুঠোফোন কোম্পানি টেলিটকের কারিগরি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান এটি। ৮ জুলাই রাঙামাটির বাঘাইছড়ির বারিবিন্দুঘাট এলাকা থেকে তাঁকেসহ বি টেকনোলজির চারজন এবং সেখানে থাকা আরেকজনকে অপহরণ করে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। অপহূত অন্য চারজন হলেন প্রতিষ্ঠানটির টেকনেশিয়ান মো. ইমরুল হোসেন ও মো. হেমায়েত হোসেন এবং অনিয়মিত টেকনেশিয়ান সুজাউদ্দিন ও তাঁর সঙ্গী খাগড়াছড়ি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মুজিবুর রহমান।

আজ ভোর চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার সীমান্তবর্তী মেরুং এলাকার জঙ্গলাকীর্ণ একটি টিলা থেকে তাঁদের উদ্ধার করে। সেখান থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে তাঁদের প্রথমে রাঙামাটি শহরের ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে এবং পরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অপহূত ব্যক্তিরা।


সবার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল মনে হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উচ্ছ্বাস ছিল তাঁদের চোখেমুখে।

মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘অনিয়মিত টেকনিশিয়ান সুজাউদ্দিনসহ আমরা খাগড়াছড়িতে একসঙ্গে থাকি। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম বাঘাইছড়ি। তারপর আমাদের এই বিপদ। কখনো মনে হতো এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাব, আবার মনে হতো পাব না। জীবনটা ছিল একদম দোদুল্যমান। অবশেষে আপনাদের সবার দোয়ায় ফিরে এলাম।’ 

টেকনিশিয়ান মো. হেমায়েত হোসেন বলেন, ‘অপহরণের দুই কি তিন দিন পর একটি বিষয়ে তর্ক করতে গিয়ে আমাকে কয়েকটা চর-থাপড় মেরেছে। এ ছাড়া আর কোনো শারীরিক নির্যাতন করেনি। তবে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিলাম। সব সময় একটা ভয়ের মধ্যে থেকেছি। পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার কথা মনে পড়ত। ভাবতাম, আর দেখা হবে কি না। এখন খুব ভালো লাগছে। আগের মতো সুন্দর জীবন ফিরে পেলাম।’


অপর টেকনেশিয়ান ইমরুল হোসেন বলেন, ‘অপহরণের পর আশা ছিল মুক্তি পাব। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল, ততই হতাশা বাড়ছিল। অপহরণকারীরা আমাদের সব সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করতো। দিনে স্থানান্তর করলে চোখ বেঁধে দেয়, রাতে হলে দেয় না। এ অবস্থায় আমরা পালানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তার কোনো সুযোগ ছিল না। অপহরণকারীরা বলত, আমাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অভিযান চালানোতে এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

অনিয়মিত টেকনেশিয়ান সুজাউদ্দিন বলেন, ‘এখন জীবনটাকে নতুন মনে হচ্ছে। এমন একটি বিপদে পড়ব জীবনে চিন্তা করিনি। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। এখন বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দেখতে পাব, এটা ভাবতেই মনটা ভরে উঠছে।’

যেভাবে রাখা হয়েছিল

অপহূত পাঁচজন জানান, অপহরণের প্রথম তিন দিন তাঁদের রাখা হয়েছিল পাশাপাশি দুটি বাড়িতে। এরপর যখন উদ্ধার অভিযান শুরু হয়, তাঁদের কখনো দিনে, কখনো বা রাতে স্থানান্তর করা হতো। রাতে সব সময় কোনো পাহাড়ের চূড়ায় অথবা ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের ঢালুতে রাখা হতো। ঘুমানোর জন্য প্লাস্টিকের ত্রিপল বিছিয়ে দেওয়া হতো। দিনে স্থানান্তরের সময় চোখ বেঁধে দেওয়া হলেও রাতে তা করা হতো না। তিন-চার দিনে মাত্র একবার গোসল করতে দেওয়া হতো পাহাড়ি ঝরনা অথবা ছড়ায়। গোসলের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র একটি লুঙ্গি।

কী খেয়েছিলেন

অপহূতরা জানান, তাঁদের প্রতিদিন দুই বেলা খাবার দেওয়া হয়েছিল। অপহরণের পর থেকে মাত্র একবার মুরগির মাংস খেতে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমদিন খাওয়ানো হয়েছিল বাঁশ কোঁড়ল। কিন্তু তাঁরা বাঁশ কোঁড়ল খেতে না পারায় তাঁদের জন্য ডালের ব্যবস্থা করা হয়। মাঝে-মধ্যে সবজি খেতে দিত। প্রতিদিন জুম ধানের ভাত খেতে দিয়েছে।