তিস্তার ভাঙনে চার গ্রাম প্রায় বিলীন

তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। ভাঙনের আশঙ্কায় বিভিন্ন জিনিস সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। পাইকানপাড়া এলাকা থেকে গতকাল ছবিটি তুলেছেন মঈনুল ইসলাম
তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। ভাঙনের আশঙ্কায় বিভিন্ন জিনিস সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। পাইকানপাড়া এলাকা থেকে গতকাল ছবিটি তুলেছেন মঈনুল ইসলাম

দস্যুর হামলা নয়, বিদেশি শত্রুর আক্রমণও নয়। নিজেরাই ভেঙে ফেলছেন নিজের হাতে গড়া আপন ঘরবাড়ি। উপড়ে ফেলছেন খঁুটি। কেটে ফেলছেন বাড়ির আঙিনার ফলবান বৃক্ষ, পাশের বাঁশঝাড়। কারণ, চেনা নদী বাড়ির দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে অচেনা ভয়ংকররূপে।
গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের চারটি গ্রামে ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে তিস্তার ভাঙন। প্রবল হয়ে উঠেছে ১৭ আগস্ট থেকে। পাইকানপাড়া, পীর সাহেবপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও ব্যাঙপাড়ার প্রায় ৭৫ ভাগ বিলীন। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩০০ পরিবার। যেখানে মাত্র ১০ দিন আগেও ছিল কাঁচা, আধা পাকা, পাকা ঘরবাড়ি, নিবিড় বাঁশঝাড়, ফলবান বৃক্ষের সবুজ সন্নিবেশ, কচি রোপা আমনের বিস্তার—সেখানে এখন কলকল, খলখল শব্দে তরঙ্গ তুলে তুমুল বেগে ছুটছে তিস্তার স্রোত।
গত বুধবার রংপুর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোতে গিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তিস্তার গভীরতার চেয়েও তার বেদনা গভীর। বাপ-দাদার আমলের ১৬ একর ফসলি জমি, এক একরের ওপর বাগানঘেরা বসতবাড়ি, সব হারিয়ে নিঃস্ব বাকের আলী এসে উঠেছেন তাঁদেরই দান করা সাড়ে তিন একর জায়গায় নির্মিত পাইকান আকবরিয়া ইউসুফিয়া ফাজিল মাদ্রাসার মাঠে। তিনি এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এখানে মাদ্রাসা ছাড়াও আছে পাইকান ইউসুফিয়া শিশুসদন ও একটি মসজিদ এবং জুম্মাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাকা, আধা পাকা ভবন। মাঝখানে বিরাট মাঠ। সেই মাঠে বাকের আলীসহ তাঁর প্রতিবেশীরা ঘরবাড়ি ভেঙে টিনের চালা, দেয়াল, আসবাব, হাঁড়ি-পাতিল, ছেলেমেয়েদের বইপত্র, ধান, চাল, শস্যের বস্তা, ড্রাম, ট্রাংক, বড় বড় কাঠের সিন্দুক, গাছের কাণ্ড, ডালপালা, বাঁশ, নলকূপের মাথাসহ সংসারের ৩৬ রকমের জিনিসপত্র এনে আপাতত স্তূপ করে রাখছেন। এক পাশে বাঁধা গবাদিপশু, পাশেই হাঁস-মুরগির পায়ে দড়ি বেঁধে ফেলে রাখা। পিতার দান করা জায়গায় নিঃস্ব বাকের আলী ক্ষণিকের ঠাঁই নিয়েছেন দারাপুত্রপরিবার নিয়ে। এরপর কোথায় যাবেন জানা নেই। ভিটেমাটি যা ছিল, সব কেড়ে নিয়েছে তিস্তা।
পাশের পাড়ায় শাহ মোহাম্মাদ জাকের আলী পীর সাহেবের বাড়ি। এই অঞ্চলে পীরের মুরিদান অনেক। বংশপরম্পরায় পীরানি সিলসিলা। তাঁদের নামেই পাড়ার নামকরণ ‘পীর সাহেবপাড়া’। শাহ জাকের আলী পীর সাহেবের নয় ঘরের বিশাল পৈতৃক পাকা বাড়ি। তিনি সামনে দাঁড়িয়ে দরজা-জানালা ভাঙার কাজের তদারক করছিলেন। বাড়ি থেকে নদী বড়জোর ১০ হাত দূরে। ভেতরের মালপত্র সরানো হয়েছে। চলছে দেয়াল ভাঙার কাজ।
গত ১৭ বছরের মধ্যে এখানে নদী ভাঙেনি। ছুটতে ছুটতেই কথা হচ্ছিল অধ্যক্ষ বাকের আলী, শাহ জাকের আলী পীর সাহেব, ছাবেদ আলী, বাকু মিয়াদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে এখানে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। তবে এতটা তীব্র নয়। সেবার পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ও আরসিসি ব্লক ফেলে ভাঙন রোধ করেছিল। পরে এখানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের পাশ দিয়ে ৩০ ফুট গভীর পর্যন্ত আরসি ব্লক দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোলকান্দায় একটি এবং জোহালি এলাকায় দুটি গ্রোয়েন নির্মাণ করা হয়। এরপর আর ভাঙন দেখা দেয়নি। এবার কেন যে নদী এমন করাল হয়ে উঠল তাঁদের বোধগম্য নয়। পুরো আষাঢ়-শ্রাবণে এবার কোনো বন্যা-বৃষ্টি ছিল না। হঠাৎ করেই ১৪ আগস্ট থেকে নদীতে পানি বাড়তে থাকে, শুরু হয় ভাঙন।
এবারও রংপুর পাউবোর লোকেরা এসে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। গত মঙ্গলবার প্রায় হাজার খানেক বালুর বস্তা ফেলেছেন। এদিন রংপুরের জেলা প্রশাসক ফরিদ আহম্মদ ও স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান এলাকা ঘুরে গেছেন বলে জানা গেছে। তাঁরা ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে গেছেন। কিন্তু ত্রাণের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বালুর বস্তা। নদীর ভাঙন ঠেকানো।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান বলেন, ১৪ তারিখ ভাঙন শুরু হওয়ার পর থেকেই তাঁরা জিও ব্যাগ, পলি ব্যাগ ও গাছগাছড়ার শিকড়-বাকড় দিয়ে তৈরি বোঝা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। স্রোত বেশি থাকায় পুরোপুরি ভাঙন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ভাঙনের পাশাপাশি গতকাল তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের জয়দেব, ছালাপাড় ও লক্ষ্মীটেরি ইউনিয়নের ইচলি, পূর্ব ইচলি ও শংকরদহ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এই গ্রামগুলোর প্রায় ৭০০ বাড়িতে পানি ঢুকেছে। ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার রোপা আমনের মাঠ। লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে সরে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।