গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার আবারও বিপত্তিতে

বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করতে পারবে না বলে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। বিধিমালা করে এই নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর ফলে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নতুন করে বিপাকে পড়েছে সরকার।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে ব্যাংকটি পরিচালনায় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োজিত করতে গিয়ে একের পর এক সংকট তৈরি হচ্ছে। এর আগে তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করা যায়নি। সরকারের নিয়োগ দেওয়া গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এক বছর আগে পদত্যাগপত্র দিলেও অন্য কেউ রাজি না হওয়ায় তা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। আর সর্বশেষ সংকট দেখা দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন নিয়ে। সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিগত তিন বছরে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া সরকারের নেওয়া আর কোনো উদ্যোগই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
গত ৬ এপ্রিল গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনের বিধিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিধিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ছয় মাস। সে হিসাবে নির্বাচনের সময় শেষ হচ্ছে আগামী ৫ অক্টোবর। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্টে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে তাগিদ দেওয়া হয়। এর পরেই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয়ে এসে দেখা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান জানিয়ে দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ সময় জানানো হয়, শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংকেরই পরিচালক নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় না।
এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তারা গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন করতে পারবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা পারেও না। আমি মনে করি, ঠিকই বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এবং সময়ও যেহেতু বেশি নেই, সরকার এখন কী করবে—জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিধিমালার যে যে জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংক আছে, তা পরিবর্তন করতে হবে।’
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন এবং তিনি (অর্থমন্ত্রী) যে পদক্ষেপ নেবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত পোষণ করে।’ এর বাইরে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
সরকারের দাবি অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫ শতাংশ মালিকানা সরকারের, আর বাকি ৭৫ শতাংশ মালিকানা ঋণগ্রহীতা সদস্যদের। এত দিন গ্রামীণ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ঋণগ্রহীতা সদস্যদের মধ্য থেকে পরিচালক নির্বাচন করা হতো।
সাধারণত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন। আর শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকেও এজিএমের মাধ্যমে পর্ষদ সদস্য নিয়োগের বিধান রয়েছে। যদিও বাস্তবে সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনের কোনো পর্যায়েই সম্পৃক্ততা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের।
সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, গ্রামীণ ব্যাংক একটি ভালো প্রতিষ্ঠান। এতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই, প্রতিষ্ঠানটিকে আগের মতোই চলতে দেওয়া উচিত। বরং হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না। এভাবে হস্তক্ষেপ করা হলে যেকোনো প্রতিষ্ঠানই প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না।’
অন্যদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যেভাবে পরিচালক নির্বাচন করতে চেয়েছিল, তাতে প্রতিষ্ঠানটিতে রাজনীতি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। যেভাবে নির্বাচন হয়ে আসছিল, সেই নিয়মই রাখা উচিত। অতীতে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচন নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নেই: বিধিমালা অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন হবে তিন স্তরে। কেন্দ্রপ্রধানেরা ভোটের মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে একজন শাখা প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। একই প্রক্রিয়ায় শাখা প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে একজন এলাকা বা এরিয়া প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এরপর এলাকা প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে হবেন অঞ্চল প্রতিনিধি। এভাবেই ৪০টি অঞ্চল প্রতিনিধি থেকে নয়জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি স্তরে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি স্তরে নির্বাচনের ভোট গ্রহণের ২০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সেই হিসাবে তিন স্তরের নির্বাচন করতে সময় লাগবে অন্তত ৬০ দিন।
কিন্তু বিধিমালা মেনে পুরো নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে এখন আর পর্যাপ্ত সময়ও নেই। সময় রয়েছে মাত্র ৩৪ দিন। তাই এই বিধিমালা অনুযায়ী নির্বাচনের আর কোনো সুযোগ নেই। এখন এই বিধিমালা সংশোধন কিংবা নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করে নির্বাচন করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য তাহসিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। মাঠপর্যায়ের সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ওই সময় পর্যন্ত পর্ষদ সদস্য থাকার আইনি অধিকার আমাদের রয়েছে।’
উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংকে বর্তমানে দুই হাজার ৫৬৭টি শাখা, ২৬৬টি এলাকা এবং ৪০টি অঞ্চল রয়েছে। প্রতিটি শাখায় গড়ে ৫৬টি করে কেন্দ্র রয়েছে। ব্যাংকের মোট কেন্দ্রের সংখ্যা এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৫। ব্যাংকের মোট সদস্য ৮৬ লাখের ওপরে।
এমডি-চেয়ারম্যান নিয়োগও ঝুলে আছে: আদালতের রায় মেনে ২০১১ সালের মে মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চলে যাওয়ার পর তিন বছরেও গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে গ্রামীণ ব্যাংক।
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমডি নিয়োগ দেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হয়। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের নয়জনই ঋণগ্রহীতা সদস্য। বাকি চারজনই সরকার মনোনীত সদস্য। ঋণগ্রহীতা সদস্যরা মাঠপর্যায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং সবাই ড. ইউনূসের সমর্থক বলে পরিচিত। এর ফলে সরকার নিজের পছন্দের এমডি নিয়োগ দিতে পারছিল না। এর পরেই ২০১২ সালের আগস্টে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে এমডি নিয়োগের বাছাই কমিটি গঠনের একক ক্ষমতা দেওয়া হয় চেয়ারম্যানকে।
কিন্তু পরের দুই বছরে ঋণগ্রহীতা নারী পর্ষদ সদস্যদের আপত্তিতে এমডি নিয়োগের বাছাই কমিটিও গঠন করা সম্ভব হয়নি। বেশ কয়েকটি পর্ষদ সভায় গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান একতরফাভাবে নিজের পছন্দমতো বাছাই কমিটি পাস করার চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু সফল হননি। অন্যদিকে নারী পর্ষদ সদস্যরা চেয়েছিলেন, বাছাই কমিটির প্রধান যেন ড. ইউনূসকে করা হয়।
মূলত এমডি নিয়োগে সফল না হতে পেরে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন বিধিমালাই পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে সরকারের পছন্দের পর্ষদ গঠন করা যায়। সাবেক সচিব মামুন উর রশিদের নেতৃত্বে গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের সুপারিশে পরিচালক নির্বাচন বিধিমালা পরিবর্তন করা হয়। গত এপ্রিল মাসে জারি করা নতুন বিধিমালায় নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই দায়িত্ব পালন করতে চায় না।
এদিকে, গত বছরের অক্টোবর মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেন। কিন্তু সেই পদত্যাগপত্র এখনো গ্রহণ করেননি অর্থমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে সরকারের উচ্চ মহল থেকে দেশের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও ক্ষুদ্রঋণ বিশেষজ্ঞকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান করার মৌখিক প্রস্তাব দিলেও তাঁরা তাতে সায় দেননি। এ কারণে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত খন্দকার মোজাম্মেল হককে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি এখন আর গ্রামীণ ব্যাংকে নিয়মিত যান না, শুধু তিন-চার মাস পর পর পর্ষদ সভা করতে যান।