বৈচিত্র্যময় বশীর

শিল্পী মুর্তজা বশীর
শিল্পী মুর্তজা বশীর

‘খেয়াল করেছ, আমার হাতের ড্রয়িং আলাদা?’ বললেন মুর্তজা বশীর।
কথাটার মানে বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে বুঝে নিয়ে ব্যাখ্যা করলেন, ‘ওই যে হাত আঁকি, তার প্রত্যেকটা হাতই আলাদা। আমার হাতগুলো কখনোই এক রকম করে আঁকি না। জানো, হাত আঁকা খুব কঠিন। মানুষের একেক মানসিক অবস্থায় হাতের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়। এখনকার শিল্পীদের দেখবে লুকিয়ে ফেলে হাত। আঁকেই না!’
এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘হাত ছাড়াও শরীরের আরেকটি অংশ আঁকা কঠিন। বলো তো কোনটা?’
তিনি যেন আগে থেকেই জানতেন, আমাদের কারও জানা নেই উত্তর, তাই নিজেই বললেন, ‘“কান।” বুঝেছ, কান আঁকাও খুব কঠিন। দেখবে, অনেক লাইন আছে হাতে আর কানে।’
যেভাবে বিরতিহীন কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাতে কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত আমাদের মনে যে শঙ্কা ছিল, সেটা গেল কেটে। ফেসবুকে দেখেছি, নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে সকাল ও রাতের ছবি পোস্ট করেছেন। ফুসফুসে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে যাচ্ছে। সেটা বের করতে হয় মাঝে মাঝেই। অক্সিজেন নিতে হয়। ফলে, দীর্ঘক্ষণ তাঁকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না, সেটাই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর বাড়িতে বেলা ১১টায় তিনি কথা বলা শুরু করলে কখন যে পৌনে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল, সেটা বোঝাই গেল না। বয়স ৮৩, হাসপাতাল ঘুরে এসেছেন ক’মাস আগেই। খুব সুস্থ হয়তো নন, কিন্তু কথা বলতে চাইছিলেন। কত দিকেই যে যাত্রা করল সেই কথামালা! কখনো ইতালি, কখনো জাপান, কখনো পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যের সখ্য কিংবা বৈপরীত্য নিয়ে কথা, কখনো একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ চলে এল—পাল আমল, স্বর্ণমুদ্রা, অটোগ্রাফের খাতা...বিষয়ের কি শেষ আছে!
আজ রাজধানীর উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হচ্ছে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী ‘আ কালেকশন অব ড্রয়িংস, কোলাজেস অ্যান্ড অয়েল প্যাস্টেলস’ ১৯৫৪–২০১৪। এই সময়ের আঁকা নতুন-পুরোনো কাজ থেকে বাছাই কিছু ছবি দেখা যাবে এখানে। ড্রয়িং, কোলাজ আর অয়েল প্যাস্টেল নিয়েই এই আয়োজন। বুধবার যখন গ্যালারিতে গিয়ে দেয়ালে টানানো ছবিগুলো দেখছি, তখনই প্রশ্নটা জাগল মনে, নতুন ছবিগুলোর মধ্যে তেলরং নেই একেবারে, শুধু অয়েল প্যাস্টেল কেন? প্রশ্ন জাগাল ‘রিভিউ’ সিরিজটির নামটি—তাঁকে জানাতেই বললেন, তেলের কাছাকাছি যাওয়া ডাক্তারের বারণ, তাই তেলরং নেই। ১৯৫৪ সালে অয়েল প্যাস্টেলে দুটো আত্মপ্রতিকৃতি আর একটা ছবি এঁকেছিলেন, এরপর এবারই আঁকলেন; নারীদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, বাইজেনটাইন ড্রয়িং ধারা আর কালীঘাট মিশে গেছে কাজগুলোতে। তাই নতুন-পুরোনোয় বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠা এই সিরিজটিই ‘রিভিউ’। কোলাজগুলো নিয়ে বললেন, ‘১৯৯০-৯১ সালের দিকে আঁকার সরঞ্জাম পাওয়া যেত কম। তখন কোলাজ করেছি। এগুলো এক্সিবিট করিনি কখনো।’
আর ড্রয়িং?

মুর্তজা ব​শীরের একটি চিত্রকর্ম
মুর্তজা ব​শীরের একটি চিত্রকর্ম


মুর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার : ‘মানুষের ভেতরে আরেকটা অমানুষও বাস করে’

মুর্তজা বশীরের শক্তিশালী ড্রয়িংয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। সিঙ্গল লাইন ড্রয়িংয়ে তাঁর মতো দক্ষ শিল্পী কমই আছেন এ দেশে। ড্রয়িং সম্পর্কে বললেন, ‘ড্রয়িং তো দুই রকম হয়, কমার্শিয়াল আর ক্রিয়েটিভ। প্রথমটায় আছে যান্ত্রিকতা, দ্বিতীয়টায় আছে হৃদয়ের ছোঁয়া। আমি হৃদয়ের ছোঁয়া দিয়েই ড্রয়িং করেছি।
পঞ্চাশের দশকে করা ড্রয়িংগুলোর মধ্যে দেখা গেল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকেও, ১৯৫৬ সালে ঢাকাতেই এঁকেছিলেন এটি। এরপর চলে যান ইতালি। সেখানে আঁকা বেশ কিছু ড্রয়িংও থাকছে প্রদর্শনীতে।
কথা বলতে গিয়ে টেনে আনছিলেন পল গগা, মাইকেলেঞ্জেলো, রেনোয়াঁ, মনে’কে। কিন্তু নিজের পছন্দের শিল্পী বলতে বতিচেল্লি, ভ্যান গঘ আর পিকাসোর কথাই বললেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে ‘এপিটাফ’ আঁকার সময় পাগলের মতো রেনোয়াঁর কাজ লক্ষ করেছেন। রেনোয়াঁর রঙের ঔজ্জ্বল্য আর ভাইব্রেশন দরকার ছিল এপিটাফের জন্য।
মুর্তজা বশীরের জীবনের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছিল ১৯৮১-৮১-এর দিকের জাপান সফর। এর আগে ইউরোপের শিল্পজগৎটাই তাঁকে গ্রাস করেছিল। কিন্তু জাপান সফরে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন নিজ ঐতিহ্যকে সম্মান করার ব্যাপারটি। অনুবাদক মেয়েটির পরনে মিনি স্কার্ট, কিন্তু উচ্ছল সেই মেয়েটি হ্যান্ডশেক করল না, জাপানি রীতিতে একটু নুয়ে অভিবাদন জানাল। এই ছোট্ট ঘটনাই যেন বদলে দিল তাঁর ভাবনার জগৎ। মনে হলো ঈশপের গল্পের সেই কাকটিকে, যে ময়ূর হতে চেয়েছিল। বুঝলেন, যতই ইউরোপিয়ান হতে চান না কেন, আসলে ফিরে আসতে হবে শিকড়ে। সেই থেকে ‘আমি কে’—এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস—সব ধরনের বই পড়তে শুরু করলেন। ‘আমি লোকগানকে মনে করতাম গ্রাম্যতা, এখন লোকগানের মধ্যেই নিজেকে খোঁজা শুরু করলাম। পালযুগের চিত্রকলা, কালীঘাটের চিত্রকলা নিয়ে কাজ শুরু করলাম। দেখলাম, আমার আগেই যামিনী রায় আর কামরুল হাসান কালীঘাট, বাঁকুড়ার পট নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তাঁরা তো পাহাড়ের মতো সুউচ্চ। তাঁদের ডিঙানো যায় না। আমার আঁকা চোখগুলো শুরুতে হলো কালীঘাটের মতো, শুধুই কালো। এরপর ওপরে কালো, নিচে বাদামি—পালযুগের মতো, এখানেও চারটা রং—নীল, সবুজ, হলুদ আর লালের ব্যবহার! এভাবেই নিজের একটা ধরন তৈরি করে নিয়েছি।’

বেশ চিন্তিত হয়ে তুললেন আরেকটি প্রসঙ্গ: খেয়াল করে দেখেছ, আমাদের এদিককার পেইন্টিংয়ে ওরিয়েন্টাল গন্ধ নেই। শিল্পীর নাম মুছে ছবিগুলো দেখাও, কোন অঞ্চলের ছবি, তা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু জাপানের ছবি দেখো, দেখবে, তুমি যেন জাপানের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যেই আছ। সে ছবিতে ফুজিয়ামা, চেরি বা কিমানো থাকতে হবে না, ছবি আঁকার স্টাইলই বলে দেবে, এটা জাপানের ছবি। আমি চেষ্টা করেছি, আমার ছবিতে নিঃশ্বাস নিলে যেন আমার অঞ্চলটাকে চেনা যায়।’
এবার কৌতূহলী প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আমার নতুন ছবিগুলো নতুন ছেলেমেয়েরা বুঝবে তো?’
আমাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী অশোক কর্মকার। তিনি বললেন, ‘আপনার এখনকার ড্রয়িং বা অয়েল প্যাস্টেলে আপনার অবচেতনের জায়গা অনেক। বোঝাই যায়, এই অঞ্চলটাকে ধারণ করে এঁকেছেন।’
খুব খুশি হলেন শিল্পী। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর দুই চোখ। বললেন, ‘তাহলে বলছ, নবীনরা আমার আঁকা থেকে নতুন কিছু পাবে?’