ছাত্রীদের কাঁধেই জরিমানার বোঝা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলগুলোতে নানা অজুহাতে ছাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। অথচ ছেলেদের হলে জরিমানার বালাই নেই। পরিচয়পত্র ও সমাবর্তন বাবদ বাড়তি ফি আদায়ের ক্ষেত্রেও এমন বৈষম্য রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা হলটির কথা বাদ দিলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য হল আছে ১৩টি, আর মেয়েদের পাঁচটি। দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজের জন্য অনাবাসিক শিক্ষার্থীদেরও এগুলোর কোনো কোনোটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি সামসুন নাহার হলের বিরুদ্ধে।
সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) সহিদ আকতার হুসাইন জানান, হলের প্রাধ্যক্ষ আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে ঠিক করেন হলটি কীভাবে পরিচালিত হবে। সিট ভাড়া বা সংস্থাপন ফির মতো বিষয়গুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ (অর্ডার), ১৯৭৩ অনুযায়ী, জরিমানা এবং বেশ কিছু ফিয়ের পরিমাণ নির্ধারণে হল কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতা রয়েছে। সহ-উপাচার্য আরও বলেন, মেয়েদের ভালোর জন্যই জরিমানার বিধান। তা ছাড়া মেয়েদের হলে নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাড়তি খরচ হয়। তাই হলগুলো বেশ কিছু ফি নেয়, যেগুলো ছেলেদের হলে নেই। ভুক্তভোগী ছাত্রীরা অবশ্য বলছেন, একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও তাঁরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
তবে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একে বৈষম্য বলতে রাজি নন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘এটি বৈচিত্র্যের বিষয়, হল থেকে হলে পার্থক্য থাকবে।’
ছেলেদের চারটি হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক এবং বিভিন্ন হলের নিবাসী ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরিমানার রেওয়াজ তাঁদের নেই। ছেলেদের অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কিছু জিনিস আইন করে বা শাস্তি দিয়ে শোধরানো যায় না।
অন্যদিকে পাঁচটি ছাত্রী হলেই কমবেশি জরিমানা আছে। পরিচয়পত্র দেরিতে হালনাগাদ করলে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শামসুন নাহার হল কর্তৃপক্ষ ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা নিত। ছাত্রীদের অসন্তোষের মুখে এখন এটা ৫০ টাকায় নেমেছে।
রোকেয়া হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে এ জরিমানার হার ১০ টাকা। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলে আবার এ খাতে কোনো জরিমানাই নেই।
পরিচয়পত্র হালনাগাদের ফি শামসুন নাহার হল নিচ্ছে ১০ টাকা করে। ফজিলাতুন্নেছা ও মৈত্রী হল নেয় ৩০ টাকা। আর সুফিয়া কামাল হল নিচ্ছে ৫০ টাকা। ছেলেদের হলে এই ফি ১০ টাকা অথবা কিছুই না।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর শামসুন নাহার হলে বাড়তি কয়েক মাস থাকার জন্য ছাত্রীদের জরিমানা করার অভিযোগ পাওয়া যায়। বর্ধিত (এক্সটেনশন) ভবনের এক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর পাশের ঘরের এক বাসিন্দা ২০১৩ সালে এভাবে বাড়তি কয়েক দিন হলে ছিলেন। এ জন্য তিনিসহ ওই কক্ষের আটজন বাসিন্দাকে মোট পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
ছাত্রীদের দাবি, মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবের বিবেচনায় তাঁদের বাড়তি কিছুদিন থাকতে দেওয়া উচিত। ছেলেদের দুটি হলের প্রাধ্যক্ষরা জানিয়েছেন, মেয়াদ ফুরোবার পর অতিরিক্ত সময় থাকলে ছাত্রদের জরিমানা করা হয় না।
গত ডিসেম্বরে শামসুন নাহার হলে অনার্স ভবনের তৃতীয় তলা থেকে ময়লা ফেলার জন্য দুজনকে ৫০০ টাকা জরিমানা করে হল কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ ভবনের একজন ছাত্রী বলেন, ২০১২ সালে তাঁর রুমমেট একদিন বারান্দা থেকে পানি ঢেলে চামচ ধুয়েছিলেন। কর্মকর্তারা দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ দুই হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। মেয়েদের অন্য হলগুলোতে এ ধরনের ঘটনায় কোনো জরিমানা হয় না।
শামসুন নাহার হলবাসীর অভিযোগ, প্রাধ্যক্ষ তাঁর ইচ্ছেমতো জরিমানা নিচ্ছেন। প্রাধ্যক্ষ সাজেদা বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য বললেন, ‘আমি হলের ব্যাপারে কোনো কথা বলব না। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা আমার পছন্দ না।’
জরিমানার টাকা কোন খাতে ব্যয় হয় জানতে চাইলে এ হলের এক কর্মকর্তা বলেন, এটা ছাত্রীদের জন্যই খরচ করা হয়। তিনি বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে জরিমানার টাকায় হল মিলনায়তনের জন্য সাউন্ড সিস্টেম ও প্রজেক্টর কেনা হয়েছে।
সুফিয়া কামাল হলে একজন আবাসিক শিক্ষক অনুমতি দিলে দপ্তরের এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে কিছু তথ্য দেন। পরক্ষণে ওই শিক্ষক ‘প্রাধ্যক্ষের অনুমতি নেই’ বলে আরেকজনকে দিয়ে প্রতিবেদকের নোট খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে নেন।
এদিকে সমাবর্তনের জন্য মূল ফি কেন্দ্রীয়ভাবে নেওয়া হয়, বিভিন্ন হল নিচ্ছে বাড়তি টাকা। ২০১৩ সালে সমাবর্তনের সময় শামসুন নাহার, কুয়েত মৈত্রী ও ফজিলাতুন্নেছা হল মেয়েদের কাছ থেকে খাত উল্লেখ না করে ৫০০ টাকা করে জমা নেয়। কিন্তু মেয়েরা বলেন, প্রতিবাদ করলে টাকাটা অর্ধেকে নেমে আসে। চলতি বছরের সমাবর্তনে ছাত্রী হলগুলো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে নিয়েছে। অন্যদিকে ছেলেদের দুটি হলে নিবন্ধন ফরমের খরচা বাবদ ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।