মানচিত্র থেকে মুছে যাবে চৌহালী?

যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সব সরকারি স্থাপনা। এলজিইডি কার্যালয়ের কার্যক্রম চলছে চৌহালী ডিগ্রি কলেজ ছাত্রাবাসের বারান্দায় l ছবি: প্রথম আলো
যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সব সরকারি স্থাপনা। এলজিইডি কার্যালয়ের কার্যক্রম চলছে চৌহালী ডিগ্রি কলেজ ছাত্রাবাসের বারান্দায় l ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের মানচিত্রে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার অবস্থান এক ঝলকেই দেখে নেওয়া সম্ভব। মানচিত্রের যে বিন্দুতে উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যালয় চিহ্নিত করা আছে, বাস্তবে তা আর নেই। যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে চৌহালী উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সব অবকাঠামো। উপজেলাটিই যাতে মানচিত্র থেকে মুছে না যায়, এখন চলছে সেই চেষ্টা।
যমুনা নদী চৌহালী উপজেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। নদীর পূর্ব পারে পাঁচটি ইউনিয়ন, পশ্চিম পারে দুটি ইউনিয়ন। গত দুই মাসে ভয়াবহ ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পূর্ব পারের পাঁচটি ইউনিয়ন।
চৌহালীর খাসকাউলিয়া ইউনিয়নে গড়ে তোলা হয় উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স। ‘উপজেলা সদর’ নামে পরিচিত উপজেলা কমপ্লেক্সের পুরোটাই এ বছর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহলে দিনভর মুখর থাকা উপজেলা পরিষদ চত্বরের নিশানাও আজ আর নেই। গত আগস্ট মাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় এবং সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর কার্যত প্রশাসনিক ‘পতন’ ঘটে চৌহালী উপজেলার।
চৌহালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুনের ভাষায়, ‘এখন আমি পানির রাজ্যের চেয়ারম্যান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছি।’
উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো—সবকিছু ভেঙে গেছে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ-ব্যবস্থা কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ বছরই উপজেলা পরিষদের আটটি ভবন, ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর, হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা না থাকা এবং দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পরায় ‘চৌহালী’ নামটি দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। তাঁরা বলছেন, যেভাবে স্থলভাগ ভাঙছে, তাতে ক্ষতির হিসাবও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। সকালে এক রকম, তো দুপুরে আরেক রকম।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের কাজ চলছে ‘সদর’ থেকে ৭০০ গজ দূরে মহিলা ফাজিল মাদ্রাসায়। গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে সেখানে অস্থায়ীভাবে কার্যালয়টি সরিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে এ বছরই আরও একবার ইউএনওর কার্যালয়টি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় গত জুলাই মাসে ইউএনওর দপ্তর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে কর্মকর্তারা জানান। এখন মাদ্রাসা ভবনও নদীভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে। পাড় ভাঙতে ভাঙতে মাদ্রাসার ৬০০ গজের মধ্যে যমুনা চলে এসেছে।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মাহমুদুল হকের সঙ্গে কথা হয় গত সপ্তাহে। তিনি বলেন, পুরো উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অবকাঠামো ভেঙে গেছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে যেখানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, অব্যাহত ভাঙনের কারণে সেসব এলাকাও নিরাপদ নয়।
ইউএনওর কার্যালয় সূত্র জানায়, দেড় লাখ জনসংখ্যার চৌহালী উপজেলার আয়তন প্রায় ২৪৩ বর্গ কিলোমিটার। গত কয়েক মাসের ভাঙনেই উপজেলার প্রায় ১০ শতাংশ যমুনায় হারিয়ে গেছে।
মহিলা ফাজিল মাদ্রাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে জোরপাড়া বাজারে চৌহালী ডিগ্রি কলেজ। এই কলেজের কয়েকটি কক্ষে সম্প্রতি থানাসহ উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে পাশাপাশি দুটি কক্ষে ঠাঁই মিলেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। জায়গা না হওয়ায় বারান্দায় বসে কাজ করতে হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরিয়ে নেওয়া হয়েছে জোরপাড়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চৌহালী আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে কোনো রকমে চলছে চিকিৎসাসেবার কাজ।
চৌহালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম বলেন, এভাবে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যা হচ্ছে। রাতে কোনো আসামি ধরলেও তাকে রাখার কোনো জায়গা নেই। তিনি বলেন, নিজেদের থাকার জায়গা নেই। যেখানে অফিস, সেখানেই থাকতে হচ্ছে। রাস্তা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের জন্য নৌকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এদিকে কলেজে সরকারি দপ্তরের কার্যালয় চালু করায় লেখাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে বলে শিক্ষার্থীরা বলছেন। আর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, যেভাবে ভাঙন চলছে, তাতে অস্থায়ী এসব কার্যালয়ও বেশি দিন থাকবে না।
চৌহালী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করেই সরকারের বিভিন্ন কার্যালয় কলেজে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কলেজ প্রাঙ্গণের জন্য দুটি টিনের ঘর উপজেলা পরিষদ থেকে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আপাতত পাঠদান চলছে।
সাম্প্রতিক ভাঙন ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাঙ্গাইল জেলার (চৌহালী উপজেলা এর আওতাধীন) নির্বাহী প্রকৌশলী জ্যোতি প্রকাশ ঘোষ বলেন, যমুনা নদীর গতি-প্রকৃতি বোঝা খুব কঠিন। ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা করা হলেও তা রোধ করা যায়নি। তিনি বলেন, দাতা সংস্থার অর্থায়নে এ বছরই যমুনা-মেঘনা মিটিগেশন প্রকল্পের আওতায় ভাঙন ঠেকাতে চৌহালী উপজেলায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনার তীর সংরক্ষণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
অব্যাহত ভাঙনে চৌহালী উপজেলার অস্তিত্ব টিকবে কি না, এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে উপজেলার স্থলভূমির সিংহভাগ ক্ষতিগ্রস্ত। বেশির ভাগ মানুষ অন্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার অবনতি হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে চৌহালী উপজেলার নামটি ধরে রাখার জন্য আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।’
জেলা প্রশাসক বলেন, চৌহালী উপজেলার পূর্ব অংশের পাঁচটি ইউনিয়নসহ টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার চার-পাঁচটি ইউনিয়ন মিলে চৌহালী নামেই একটি উপজেলা স্থাপন করা যেতে পারে। এটি টাঙ্গাইল জেলার আওতায় থাকবে। অপর দিকে চৌহালীর বাকি দুটি ইউনিয়নসহ শাহজাদপুর উপজেলা থেকে চারটি ইউনিয়ন নিয়ে এনায়েতপুরে আরও একটি উপজেলা পরিষদ করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে চৌহালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, উপজেলাটি টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে প্রশাসন থেকে, এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা শুনেছি। উপজেলা থেকে টাঙ্গাইলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হলেও চৌহালীর মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য এলাকার মিল নেই।
তবে চৌহালী উপজেলা ভেঙে নতুন উপজেলা করার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব তাঁরা এখন পর্যন্ত পাননি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের (বেলকুচি-চৌগাছা) সাংসদ আবদুল মজিদ মণ্ডলের মুঠোফোনে কল করা হয়। রিং বাজলেও তিনি ধরেননি।