'প্রথম সুযোগেই দেশে ঢুকে পড়ব'

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী

নিজ দল আওয়ামী লীগ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, ভারত থেকে ‘প্রথম সুযোগেই’ তিনি বাংলাদেশে ‘ঢুকে পড়তে’ চান। এ জন্য তিনি সরকার ও দলের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন। তবে শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরা না হলে তিনি ভারতের আশ্রয়ে থাকতে চান। কলকাতায় অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকী আজ সোমবার সন্ধ্যায় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে এ কথা বলেন।
সাক্ষাত্কারটির হুবহু তুলে ধরা হলো:
বিবিসি:
সরকার এবং দল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কীভাবে নিচ্ছেন?
লতিফ সিদ্দিকী: আমার প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। কারণ আমি একটা দল করি। দলের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে। সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি বলে আমার দলনেতা মনে করেছেন। সেই জন্য দলের নেতা ব্যবস্থা নিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ ফোরামে বসে। সো, এটা নিয়ে আমার তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা না। এই দলই আমাকে মন্ত্রী বানাইছে। এই দলের নেতাই আমাকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তিনি বা তাঁর সহকর্মী মিলে যদি আমাকে মনে করেন যে আমি সহকর্মী হওয়ার যোগ্যতা রাখি না; সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতন্ত্রে তো এটা কোনো অপরাধ না।

বিবিসি: তাঁরা মনে করেছেন, কিন্তু আপনি কি সেই... তাঁদের যে মনে করা, আপনি তাঁদের সঙ্গে একমত?
লতিফ সিদ্দিকী: আমি একমত, কারণ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।
বিবিসি: আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে যে আপনার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে?
লতিফ সিদ্দিকী: না, না। বরঞ্চ আমি অনুতপ্ত যে আমি আমার দল, আমার দলনেতাকে একটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি।
বিবিসি: এ ছাড়া অন্য কোনো অনুশোচনা হচ্ছে? পুরো অবস্থার জন্য কি কোনো অনুশোচনা হচ্ছে?
লতিফ সিদ্দিকী: না, আমার কোনো অনুশোচনা বা অনুতাপ নেই। আমার নেতাকে আমি বিব্রত করেছি। তিনি আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন, আমি তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছি।
বিবিসি: কিন্তু আপনি যেটা বলেছিলেন, সেটা নিয়ে কি কোনোভাবে কোনো ধরনের অনুশোচনা হচ্ছে?
লতিফ সিদ্দিকী: আবার বলি, আপনারা কিন্তু আমাকে শোনাতে চেয়েছিলেন, আমি কিন্তু বলি নাই। আমার এই জায়গাটায় একটা আক্ষেপ আছে যে সারা পৃথিবীতে কি একজন সাংবাদিক বা একজন মানুষ নেই যে জিজ্ঞেস করল না উনি একটা আড্ডাতে কথা বলেছেন। কোনো সভায় নয়, কোনো সমিতিতে নয়, মাইকে নয়। তো, সেই আড্ডায় উনি পুরোটা কী কথা বললেন, সেইটা না জেনে একটা খণ্ডিত অংশ, বিকৃতও হতে পারে, অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। তো পুরোটা কেউ চাইলেন না আজ পর্যন্ত। এইটা আমার আক্ষেপ আছে। আমি পুরো কথাটার দায়িত্ব নিচ্ছি। দেড় ঘণ্টা আমি কথা বলেছি। সেই দেড় ঘণ্টার টেপটা আপনারা বাইর করান, সেটার পুরো দায়িত্ব আমার। এর জন্য আমার যদি ফাঁসি দেওয়া হয়, তা-ও আমি মেনে নেব।
বিবিসি: তো যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এখন আপনার পদক্ষেপ কী হবে? আপনি কি দেশে ফিরছেন?
লতিফ সিদ্দিকী: আমি দেশে ফিরতে আগ্রহী। কারণ এই দেশটার স্বাধীনতার জন্য আমি কাজ করেছি। আমি এই দেশটার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। কিন্তু প্রেক্ষাপটটা এমন হয়েছে যে, আমি কী করব আমি বুঝতে পারছি না। কারণ, আমি দেশে গেলে, ঢুকে গেলে, আমার নেতা যদি আরও বিব্রত হয়, সেই জন্যে আমি খুবই মানসিক সংকটে আছি। আমি প্রথম সুযোগেই দেশে ঢুকে পড়ব। গিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করব।

বিবিসি: তার মানে আপনি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

লতিফ সিদ্দিকী: বিষয়টা কিন্তু তা না। নেতা বা আমার দলের কোনো ক্ষতি হবে কি না আমি ঢুকলে, সেইটা নিয়ে আমি চিন্তিত। আমাকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই।
বিবিসি: কিন্তু দেশে না ঢোকা পর্যন্ত তো সেটা আপনি বুঝতে পারছেন না।
লতিফ সিদ্দিকী: না, না, বুঝতে পারার কথা না। আমাকে তো কিছুটা জানতে হবে। জানতে আমি পারব।
বিবিসি: আপনি দলের কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছেন যে দল আপনাকে বলবে, ‘না তুমি এসো না’ বা ‘তুমি থাকো’।
লতিফ সিদ্দিকী: অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই।
বিবিসি: দলের নেতার সঙ্গে কি আপনি নিজে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন?
লতিফ সিদ্দিকী: দলের নেতা মানে শেখ হাসিনার সাথে? না আমি চেষ্টা করি নাই।
বিবিসি: দলের কোনো পর্যায়ের সঙ্গে কি যোগাযোগের চেষ্টা করছেন যে আপনার কী করা উচিত? মানে আপনি আসবেন কি না?
লতিফ সিদ্দিকী: না, না, না, না।
বিবিসি: তার মানে আপনি চাইছেন তাঁরাই আপনাকে বলুক? আপনি সেটাই চাইছেন?
লতিফ সিদ্দিকী: না, আমি চাইছি না। তাঁরা কী করবেন তা তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিবিসি: মিস্টার সিদ্দিকী, এর আগে আমরা যেটা দেখেছি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে ধরুন দুজন লেখক, একজন মহিলা একজন পুরুষ। তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার-তাঁরা...তাঁদের সম্পর্কে একই ধরনের অভিযোগ ওঠার পর তাঁরা আর দেশেই ফিরতে পারছেন না। বছরের পর বছর। দশকের পর দশক। আপনার কি সেই ভয়টা হচ্ছে যে আপনারও সেই পরিস্থিতি হতে পারে?
লতিফ সিদ্দিকী: না, না, তারা লেখনীর মাধ্যমে বলেছে। তারা এক কথা বলেছে আর আমি তো এখনো বলছি যে আমার অবস্থান... আমার কথাগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে, খণ্ডিত করা হয়েছে। একত্রিত যোগ করলে দেখা যাবে আমি একটা অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণ করেছি।
বিবিসি: কিন্তু মানুষ, মানুষের যে পারসেপশন। মানুষ যেটা মনে করছে যে আপনি তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। আপনার ভিতরে কি ভয় জাগছে যে আপনারও ... দেশে ফিরতে পারবেন কি না?
লতিফ সিদ্দিকী: সেটা দেখা যাবে। সময়ই বলে দেবে। আমার জীবনে এ রকম ঝড় বহুবার এসেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলাম। তারপর বিতাড়িত হয়েছিলাম। কয়দিন যুদ্ধও করেছি। তারপর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার দ্বিমত হয়েছে বলে আমি সরে এসেছিলাম। এখনো কাদের সিদ্দিকী ক্ষমা চাচ্ছে। এই ব্যাটাকে কে ক্ষমা চাওয়ার আমার পক্ষ থেকে দিল? আমি তো তাঁকে দায়িত্ব দেই নাই যে আমার পক্ষে ক্ষমা চাও। সে এক দল করে, আমি আরেক দল করি। সে আমার বিরুদ্ধে ২০০১-এ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আমাকে পরাজিত করেছিল।
বিবিসি: আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন মিস্টার সিদ্দিকী—আপনি যদি অদূর ভবিষ্যতে দেশে ফিরতে না পারেন, আপনার দল যদি আপনাকে সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত না দেয় যে আপনি ফিরুন, আপনি এখনো এমপি আছেন। আপনি কোথায় থাকবেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপাতত?
লতিফ সিদ্দিকী: না, না।
বিবিসি: আপনি কি ভারতেই থাকবেন?
লতিফ সিদ্দিকী: আমি ইউরোপ-আমেরিকায় থাকতে পারব না। আমি ইউরোপ-আমেরিকায় থাকতে পারব না বলেই আমি কলকাতায় এসেছি। আমি একেবারেই মাটির সাথে থাকতে চাই। মাটির সোদা গন্ধে আমার... আমি খুব একটা সাধারণ মানুষ ভাই।
বিবিসি: ভারতে কি আপনি থাকতে পারবেন? কোনো ইঙ্গিত ভারত সরকারের কাছে...
লতিফ সিদ্দিকী: ভারত সেটা না দিলে,... সেটা এখনই... সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলব না। সময় সামনে বলে দেবে। সময়ই সময়ের সিদ্ধান্ত নেবে। এখন কিছু বলব না।