দীর্ঘ অপেক্ষার পর নিজামীর মামলার রায় কাল

মতিউর রহমান নিজামী
মতিউর রহমান নিজামী

অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অপেক্ষমাণ রায় কাল বুধবার ঘোষণা করা হচ্ছে৷
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আজ মঙ্গলবার এ দিন ধার্য করেন।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা মামলাটির নিষ্পত্তি হবে৷
গত ২৪ জুন এই মামলার অপেক্ষমাণ রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করে তিনি অসুস্থ বলে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন পাঠায়৷ এ ব্যাপারে তখন ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র ও রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দীন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষের ওই নথিতে বলা হয়েছে, নিজামী অস্বাভাবিক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন৷ এ জন্য নড়াচড়া না করিয়ে তাঁর বিশ্রাম দরকার৷’
আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত মনে না করায় ওই দিন (২৪ জুন) ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় দফায় নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন৷ শুনানি শেষে ওই দিন আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন পেয়েছি৷ ওই প্রতিবেদন অনুসারে আসামি মতিউর রহমান নিজামী অসুস্থ৷ আমরা দুই পক্ষের শুনানি শুনলাম৷ এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট যেসব আইন ও বিধি আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে আমরা আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেওয়া যুক্তিসংগত মনে করছি না৷ এ জন্য আজ রায় দেওয়া হচ্ছে না৷ তবে যত দ্রুত সম্ভব রায় দেওয়ার জন্য আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আসামির পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন চাচ্ছি৷ সে পর্যন্ত মামলাটি আবার রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হলো৷’
নিজামীর অসুস্থতার ব্যাপারে পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ জুন দিবাগত রাত তিনটার দিকে তাঁর (নিজামী) উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়৷ পরদিন (২৪ জুন) সকাল আটটা পর্যন্ত তিনি অসুস্থ ছিলেন৷ কারা চিকিৎসকেরা তাঁকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেন৷ চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়নি৷ দুপুরে কারা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে দেখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন৷ তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে৷
ট্রাইব্যুনালে সবচেয়ে বেশি সময় প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা মামলা এটি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ২০১২ সালের ২৮ মে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচার শুরু হয়৷ সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত বছরের ১৩ নভেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়৷ তবে রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর৷ ৫৩ দিন পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনেন৷ ২৪ মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়৷ এর প্রায় তিন মাস পর গত ২৪ জুন এই মামলার অপেক্ষমাণ রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য ছিল। ওই দিন কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে হাজির না করে তিনি অসুস্থ বলে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন পাঠানোয় তৃতীয় দফায় রায় অপেক্ষায় রাখা হয়৷
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন ছাড়াও নিজামীর বিরুদ্ধে মামলাটিতে দীর্ঘসূত্রতার আরও কারণ আছে৷ এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণই চলেছে প্রায় দেড় বছর৷ এ ছাড়া নিজামী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি হওয়ায় তাঁকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো৷ এ জন্যও এই মামলার কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়৷ গত ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়৷
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ৷ রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো অভিযোগ রয়েছে৷ একাত্তরে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা বা রাজধানীর নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা রুমী, বদি, জালাল, সুরকার আলতাফ মাহমুদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজামীর সংশ্লিষ্টতা ছিল৷ এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত রাজাকার-আলবদরের ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের যে নীলনকশা বাস্তবায়িত হয়, তাঁর সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা ছিল৷ রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, এসব অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে পেরেছে, সেই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের জন্য নিজামীর দায়ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷
তবে আসামিপক্ষের দাবি, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এসব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়নি৷ এ জন্য নিজামীকে খালাস দেওয়া উচিত৷
১৯৪৩ সালে সাঁথিয়ার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী একাত্তরে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন, বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন৷ রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, তিনি একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক বাহিনী আলবদরের প্রধান ছিলেন৷

২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷