বদলে গেছে দুই কোটি জীবন

সৌর বিদ্যুতে চলছে সেচযন্ত্র। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার শিকারপুর গ্রাম থেকে গত বোরো মৌসুমে তোলা ছবি l প্রথম আলো
সৌর বিদ্যুতে চলছে সেচযন্ত্র। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার শিকারপুর গ্রাম থেকে গত বোরো মৌসুমে তোলা ছবি l প্রথম আলো

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর রাতের আঁধার আলো ঝলমলে করে তুলছে সৌরবিদ্যুৎ। ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ বাড়ি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের (সোলার হোম সিস্টেম) আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৫০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে।
এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার বাড়িতে নতুন করে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপিত হচ্ছে। এটি পৃথিবীর দ্রুততম ও সফলতম সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দাতাগোষ্ঠী ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে। নতুন লক্ষ্য হচ্ছে, ২০১৭ সালের মধ্যে ৬০ লাখ বাড়ি সৌরবিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনা।
অবশ্য গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাড়িভিত্তিক সৌর-বিদ্যুতের ৩০ লাখ প্যানেল স্থাপনের মাইলফলক সাফল্য’ উদ্যাপনের লক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছেন। তবে এরই মধ্যে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল সংখ্যা ৩৫ লাখে উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)।
সরকারি মালিকানাধীন এই কোম্পানিটিই রয়েছে বাড়িিভত্তিক সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের সাফল্য অর্জন ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের ৪৭টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ‘অংশীদার সংগঠন’ হিসেবে ইডকলের সার্বিক তত্ত্বাবধান
ও অর্থায়নে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্থাপনের কার্যক্রম সরকারিভাবে শুরু হয় ২০০৩ সালে। তখন লক্ষ্য ছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার বাড়িকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা। কিন্তু পাঁচ বছর লাগেনি, তিন বছরেই সে লক্ষ্য অর্জিত হয়। এর অন্যতম কারণ, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিপুল আগ্রহ।
এই ক্ষেত্র তৈরি করেছিল গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি। প্রতিষ্ঠানটি বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু করে ১৯৯৬ সালে। ২০০৩ সালে যখন ইডকলের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়, তত দিনে গ্রামীণ শক্তি প্রায় ২০ হাজার বাড়িতে সংযোগ দেওয়া সম্পন্ন করেছে।
বর্তমানে ইডকলের মাধ্যমে যে ৪৭টি অংশীদার সংগঠন কাজ করছে, তার মধ্যে গ্রামীণ শক্তিই সর্বোচ্চসংখ্যক (৩০ শতাংশের বেশি) বাড়িতে প্যানেল স্থাপন করেছে। এই কর্মসূচি দেশের প্রত্যন্ত এলাকা, দ্বীপাঞ্চল প্রভৃতি স্থানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা নেই।
সৌরবিদ্যুৎ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। সৌরবিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা ও বাজারে অনেক রাত পর্যন্ত কেনাবেচা চলছে। সেচযন্ত্র চালাতেও সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০টি নলকূপ সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে চালানো হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপসহ ৫০টি স্থানে ক্ষুদ্র গ্রিড তৈরি করে বিদ্যুৎ সরবরাহের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। দেশে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়েছে নয়টি।
সংযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া: ইডকলের অংশীদার সংগঠনগুলো গ্রাহকের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করে। শুরুতে গ্রাহককে মোট দামের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নগদ পরিশোধ করতে হয়। এরপর সমান মাসিক কিস্তিতে তিন বছরে অবশিষ্ট দাম পরিশোধ করতে হয় সামান্য সুদসহ। তিন বছর পর গ্রাহক বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাটির (সিস্টেম) মালিকানা স্বত্ব পান।
কোনো গ্রাহক ৩০ ওয়াট পিকের একটি সিস্টেম কিনলে (বর্তমান দাম ১৫ হাজার ৫০০ টাকা) দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মতো নগদ দিতে হবে। এরপর তাঁকে এই ক্ষমতার একটি সৌর প্যানেল, তিন ওয়াট ক্ষমতার দুটি এলইডি লাইট, একটি ব্যাটারি, একটি চার্জ কন্ট্রোলার (ব্যাটারির চার্জ নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র), প্যানেলটি স্থাপনের একটি ফ্রেম ও প্রয়োজনীয় তার দিয়ে সিস্টেমটি স্থাপন করে দেওয়া হবে। তাঁকে প্যানেলের জন্য ২০ ও ব্যাটারির জন্য পাঁচ বছরের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। তিন বছর পর্যন্ত মেরামতের সেবাও দেওয়া হয়।
৩০ ওয়াটের এই সিস্টেমটির মাধ্যমে দুটি লাইট ও একটি এলসিডি বা এলইডি সাদাকালো টেলিভিশন চালানো যাবে। সৌরবিদ্যুতের এই ব্যবস্থায় বৈদ্যুতিক পাখাও চালানো যায়। তবে তা ডিসি (ডিরেক্ট কারেন্ট) বিদ্যুচ্চালিত হতে হবে। আর ৭৫ ওয়াটের কম ক্ষমতার প্যানেলে সাধারণত পাখা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় না। কারণ, পাখায় বিদ্যুৎ খরচ হয় বেশি। একটি পাখা চালাতে তিন ওয়াটের চারটি লাইটের সমান বিদ্যুৎ লাগে।
বর্তমানে দেশে পাঁচ থেকে ১৩৫ ওয়াটের প্যানেল গ্রাহকেরা কিনছেন। ১৩৫ ওয়াটের একটি প্যানেলসহ সিস্টেমের দাম ৪৬ হাজার ১০০ টাকা। এই ক্ষমতার সিস্টেমের সাহায্যে ১২টি লাইট, দুটি পাখা ও একটি টেলিভিশন চালানো যাবে।
অংশীদার সংগঠনগুলো গ্রাহককে দেওয়া টাকা কীভাবে সংগ্রহ করে, জানতে চাইলে ইডকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ মালিক প্রথম আলোকে জানান, সংগঠনগুলোর বিনিয়োগ করা অর্থের ৮০ শতাংশ ইডকল ৬ থেকে ৯ শতাংশ সুদে পাঁচ বছরের জন্য ঋণ হিসেবে দেয়। এই টাকা ইডকল পায় সরকারের কাছ থেকে ৩ শতাংশ সুদে। সরকার পায় দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ ও অনুদান হিসেবে। এই খাতে দাতাগোষ্ঠীর মধ্যে আছে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, ইউকে এইড, ইউএসএআইডি, জিআইজেড, কেএফডব্লিউ প্রভৃতি সংস্থা।
গ্রামীণ শক্তির জিটিসি: সৌরবিদ্যুতের গ্রাহকদের দেওয়া সেবার নিশ্চয়তার (গ্যারান্টি) সময় যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন গ্রাহক সেবা পাবেন কোথায়। এ জন্য ইডকলের ৪৭টি অংশীদার সংগঠনের মধ্যে একমাত্র গ্রামীণ শক্তি গড়ে তুলেছে ‘গ্রামীণ টেকনিক্যাল সেন্টার (জিটিসি)।
গ্রামীণ শক্তির পরামর্শক এম এ গোফরান প্রথম আলোকে জানান, বর্তমানে সারা দেশে তাঁদের ৩৪টি জিটিসি আছে। সেগুলোতে প্রায় ২৩ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারিগর আছেন, যাঁদের ৮০ শতাংশই নারী। এই কেন্দ্রগুলোয় বসে তাঁরা মোবাইল চার্জার, চার্জ কন্ট্রোলার ও আরও কিছু ছোট জিনিস তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেন। একই সঙ্গে তাঁরা সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া তাঁরা সৌরবিদ্যুতের প্রায় ৭৭ হাজার গ্রাহককে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদেরও অধিকাংশ নারী। তাঁরা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রতিবেশীদের জন্যও কাজ করে থাকেন।
খরচ কেমন: ইডকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রত্যন্ত এলাকার একটি পরিবার প্রতি মাসে অন্তত চার লিটার কেরোসিন ব্যবহার করে, যার দাম ২৮০ টাকা। এখন তিনি এককালীন দেড় হাজার টাকা দিয়ে ২০ ওয়াটের একটি সিস্টেম নিলে প্রতি মাসে তাঁকে প্রায় সমপরিমাণ অর্থই পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু তিন বছর পর তাঁকে আর কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। অথচ প্যানেলটি তিনি ২০ বছর ব্যবহারের নিশ্চয়তা পান।

সৌরবিদ্যুৎ
৩৫ লাখ বাড়ি ব্যবহারের আওতায় এসেছে
১০০ নলকূপ চালানো হচ্ছে
৬৫ হাজার বাড়িতে প্রতি মাসে প্যানেল বসছে

প্রত্যন্ত এলাকা ও চরাঞ্চল
পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা, মুঠোফোনে চার্জ দেওয়া, রাতে বাজারে বেচাকেনা চলছে সৌরবিদ্যুতে

১৩৫ ওয়াটের প্যানেল
১৩৫ ওয়াটের একটি প্যানেলসহ সিস্টেমের দাম ৪৬ হাজার ১০০ টাকা। ১২টি লাইট, দুটি পাখা ও একটি টেলিভিশন চলে