মামলা করাই তাঁর নেশা ও পেশা

এ বি সিদ্দিকী
এ বি সিদ্দিকী

রাজনৈতিক নেতাদের নামে অন্তত ১০টি মামলা করেছেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। সারা দেশে সংগঠনকে পরিচিত করার লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মামলা করে যেতে চান তিনি। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, গরিব মানুষ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পেতেই তাঁর এই চেষ্টা।
গত ২২ অক্টোবর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এ বি সিদ্দিকীর দীর্ঘ সময় কথা হয়। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থানার বর্ষাপাড়া গ্রামে। বর্তমানে তিনি ঢাকার রামপুরার মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় থাকেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের খদ্দর শপিং কমপ্লেক্সে একটি অফিস নিয়ে আছেন। ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে দৈনিক ভোরের আলো, সাপ্তাহিক অবদান ও চিত্রজগত- এর সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পত্রিকাগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত নয়।
নিজের আয় সম্পর্কে এ বি সিদ্দিকী বলেন, পত্রিকাগুলো অন্যদের চালাতে দিয়েছেন, সেখান থেকে তিনি কিছু টাকা পান। এ ছাড়া রামপুরায় তাঁর ছেলে ফোন-ফ্যাক্সের ব্যবসা করেন, সেখান থেকেও কিছু আসে। আর যেসব আইনজীবী তাঁর করা মামলায় লড়েন, তাঁরাও তাঁকে টাকা দেন।
এ বি সিদ্দিকী মনে করেন, অন্যরা আলোচনা সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে সংগঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে। তিনি মামলা করে তাঁর সংগঠনকে সেভাবে তুলে ধরছেন। তাঁর ভাষ্য, আলোচনা সভা ও মানববন্ধন করতে অনেক টাকা লাগে। এ নিয়ে মানুষও নানা কথা বলে। যখন এগুলো করে সুবিধা করতে পারেননি, তখন থেকে তিনি রাজনৈতিক মামলা দেওয়া শুরু করেন। এখন তাঁর কর্মব্যস্ততা কেবল মামলাকেন্দ্রিক।
মামলা করার টাকা পান কোথায়—জানতে চাইলে এ বি সিদ্দিকীর জবাব, ‘টাকা লাগে না তো। আমি মামলা করতে চাইলেই আইনজীবীরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা আগ্রহ দেখিয়ে আমার মামলা নেন, শুনানি করেন। পরে মিডিয়াতে বক্তৃতা দেন। এতে তাঁরাও হাইলাইটস হন।’
এ বি সিদ্দিকীর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন খলিলুর রহমান। এ প্রসঙ্গে খলিলুর রহমান বলেন, এ বি সিদ্দিকীর করা মামলা পরিচালনা করতে তিনি কোনো অর্থ নেন না। এখানে কোথাও থেকে তিনি কোনো সুবিধাও পাননি। শুধু গণমাধ্যমে তাঁর নাম আসে—এতেই তিনি সন্তুষ্ট।
আপনি কী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন—এ প্রশ্নের জবাবে এ বি সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি সব সময় পত্রপত্রিকায় দেখি বিরোধী দলের কে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জয়কে নিয়ে কিছু বলেছে কি না। বললেই মামলা করে দিই। সারা দিনই আমি মামলার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে এ বি সিদ্দিকী বলেন, ‘না। তবে বিএনপিপন্থী কিছু ব্যক্তি যখন দেশনেত্রী পরিষদ করল, এর জবাবে আমি জননেত্রী পরিষদ করেছি।’
জননেত্রী পরিষদ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ বি সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাকে নেত্রী বলেছেন, কমিটি গঠন করে দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি অনুমোদন দিয়ে দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘কমিটি গঠন করতে অনেক টাকা লাগে। এ জন্য কমিটি করতে পারছি না।’
মামলা করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পেতে তিনি এটা করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। তিনি যদি আমাকে গণভবনে একটা কাজ দেন, তাহলে আমি সচ্ছলভাবে চলতে পারি। শুনেছি, এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।’
মামলার নথিপত্র থেকে দেখা যায়, ৫০০, ৫০১ ও ৫০৬ ধারায় মানহানির মামলা বেশি করেছেন এ বি সিদ্দিকী। এ পর্যন্ত তিনি ১০টি মামলা করেছেন। আর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) যে কতগুলো করেছেন, এর কোনো হিসাব নেই। এর মধ্যে চারটিই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। যদিও দুটি মামলা ইতিমধ্যে খারিজ হয়ে গেছে।
২০১১ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করার মাধ্যমে এ বি সিদ্দিকী তাঁর মামলার কার্যক্রম শুরু করেন। এর পর তিনি পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রভাষক হাফিজুর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মজিবুর রহমান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এম ওহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন।
সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগকে ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী দল বলায় সংক্ষুব্ধ হয়ে এ বি সিদ্দিকী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলো কে বলেন, সাধারণত মানহানি মামলা সরাসরি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির করতে হয়। কিন্তু তাঁর (এ বি সিদ্দিকী) মামলাগুলো সরাসরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিচারব্যবস্থাটা এখন ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ক্রমশ রাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। এ ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা চলতে থাকলে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে।