ঢাকার ৭৬% রিকশাচালক মুঠোফোনে টাকা পাঠান

ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রিকশাচালক মুঠোফোনের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠান। এর ফলে তাঁদের ঝুঁকি কমছে এবং অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।
গত বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত পরিচালিত এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান এ জরিপ পরিচালনা করেন।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ৪৬১ জন রিকশাচালকের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৩৫০ জনই মুঠোফোনে বাড়িতে টাকা পাঠান। তাঁদের বেশির ভাগ রংপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলের বাসিন্দা। গড়ে প্রতি সপ্তাহে জনপ্রতি পাঠানো টাকার পরিমাণ ৯৮১ টাকা।
জরিপের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অধ্যাপক সালাহউদ্দিন বলেন, ‘প্রান্তিক মানুষকে ব্যাংকিং সুবিধায় আনার ক্ষেত্রে (ইনক্লুসিভ ব্যাংকিং) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টা কতটুকু কার্যকর, সেটি বুঝতেই এ জরিপ করা হয়। এ সুবিধার ব্যাপক ব্যবহার আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার ধারণা, এখন এ সুবিধা নেওয়া রিকশাচালকের সংখ্যা আরও বেড়েছে।’
২০০৮ সালে বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতে সাফল্যের জন্য গত ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর ফিন্যানশিয়াল ইনক্লুশনের (এএফআই) পলিসি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জরিপের সূত্র ধরে গত বুধবার রাতে রাজধানীর ফার্মগেট ও মণিপুরিপাড়া এলাকায় কমপক্ষে ১০ জন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের মধ্যে আটজনই মুঠোফোন ব্যবহার করে বাড়িতে টাকা পাঠান। তাঁদের একজন জয়নাল আবেদিন। বাড়ি দিনাজুপরের পার্বতীপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামে। তিনি ঢাকায় রিকশা চালান ১২ বছর ধরে। জানালেন, ‘আমি চ্যালে অ্যাক্ষুনি ট্যাকা পাঠাব্যার পারি। র্যা ত নাই, দিন নাই। এখন তো বাড়িত দুই-তিন দিন পর পর ট্যাকা পাঠাই।’
রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মুঠোফোনে টাকা পাঠানোর কারণে তাঁদের ভোগান্তি কমেছে বহু গুণ। আগে অন্যের কাছে টাকা পাঠালে সেটা অনেক সময় খোয়া যেত। আবার জরুরি প্রয়োজনে এলাকায় টাকা পাঠানোও ছিল কষ্টসাধ্য। নিজে টাকা বহনেরও ঝুঁকি ছিল। আবদুল লতিফের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার দুলালী গ্রামে। ঢাকায় রিকশা চালান আড়াই বছর ধরে। জানান, এখন বাড়ি যাওয়ার সময় কেবল বাসের ভাড়া ও কিছু বাড়তি টাকা নিজের কাছে রাখেন।
মুঠোফোন প্রযুক্তি ঘুচিয়ে দিয়েছে দূরত্ব। জরিপে অংশ নেওয়া রিকশাচালকদের ৮৯ শতাংশ জানান, বাড়ি পর্যন্ত টাকা পৌঁছাতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। ১৫ মিনিটের বেশি লাগে ১১ শতাংশ মানুষের।
রিকশাচালকেরা জানান, ঢাকায় কোনো এজেন্টের দোকানে গিয়ে টাকা পাঠান। গ্রামে বাড়ির লোকজন নির্দিষ্ট এজেন্টের কাছ থেকে সেই টাকা উঠিয়ে নেন। জরিপে অংশ নেওয়া রিকশাচালকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই বিবাহিত। এঁদের মধ্যে ৫২ শতাংশ টাকা পাঠান বাবা-মায়ের কাছে। স্ত্রীর কাছে পাঠান ৩২ শতাংশ। আমাদের সামাজিক সম্পর্কের বুনট যে সুদৃঢ়, টাকার গন্তব্যের চিত্রে সেটিই ফুটে ওঠে—এ মন্তব্য অধ্যাপক সালাহউদ্দিনের।
একই পরিবারে একত্রে দুই বা তিনটি কাজেও ব্যবহৃত হয় পাঠানো টাকা। জরিপে রিকশাচালকদের পাঠানো টাকার এই বহুমুখী ব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে। টাকার ৭৫ ভাগই ব্যয় হয় খাদ্য কেনাসহ সাংসারিক খরচ চালাতে। ৩১ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সন্তানের শিক্ষায়, জমি রাখাসহ ক্ষুদ্র বিনিয়োগে যায় ৩৫ ভাগ, ছোট ব্যবসায়ে ৩২ ভাগ। এ টাকায় ঋণ শোধও হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, প্রযুক্তি ব্যবহারের উঠে আসা চিত্র প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের একটি উদাহরণ। তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম এর ফলে সংহত হয়েছে। পরিবারের উপায়ক্ষম ব্যক্তি কাছে না থাকলে পরিবারে অসহায়ত্ব দেখা দেয়। পুঁজির এ সহজ গমনের পথ তৈরি হওয়ায় সেই অসহায়ত্ব কমবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব খুবই ইতিবাচক।
সন্তানের শিক্ষায় বড় অঙ্কের টাকার ব্যবহারকেও শিক্ষার প্রসারে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, একটি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল জীবনের আকাঙ্ক্ষা এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে।