বাথরুম পর্যাপ্ত হলেও নোংরা ব্যবহারের অনুপযোগী

প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘স্কুল স্যানিটেশন: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা l প্রথম আলো
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘স্কুল স্যানিটেশন: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা l প্রথম আলো

দেশের বিদ্যালয়গুলোতে বাথরুমের সংখ্যা যথেষ্ট বলা যায়। কিন্তু এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় অর্ধেক বাথরুমই বন্ধ থাকে। বেশির ভাগ বাথরুম নোংরা ও ব্যবহারের অনুপযোগী। সেখানে হাত ধোয়ার উপকরণ বা সুযোগ নেই।
সরকারের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখতে শিক্ষকদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। বিষয়টি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরদারিতে আনার প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। তা ছাড়া এ খাতে একটি পৃথক সংরক্ষিত তহবিল তৈরি, শিক্ষা কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে বাথরুম দেখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, পরিবার থেকেই শিশুদের বাথরুম ব্যবহার করা শেখানো, স্টুডেন্ট কাউন্সিলকে বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্বুদ্ধ করা ও দায়িত্ব দেওয়া এবং জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
‘স্কুল স্যানিটেশন: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল শনিবার এসব পরামর্শ দেওয়া হয়। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ওই বৈঠকের আয়োজক ছিল প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ওয়াটার এইড বাংলাদেশ, শেয়ার রিসার্চ কনসোর্টিয়াম ও গণসাক্ষরতা অভিযান।
স্কুল স্যানিটেশনের বিষয়ে ব্যাপক প্রচার শুরুর আহ্বান জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এটা এমন একটি জাতীয় ইস্যু, যা বাস্তবায়নে ‘লো কস্ট ক্যাম্পেইন’ শুরু করা যেতে পারে।
স্কুল স্যানিটেশন বিষয়ে সুফল পেতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতগুলোকে যুক্ত করার আহ্বান জানান রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, শিক্ষক, মুরব্বি বা পুরুষদের সামনে বাথরুমে যাওয়া যাবে না—এই ধারণা এখনো মেয়েদের মধ্যে আছে। শিক্ষকদের অনেকেই অষ্টম শ্রেণিতে বয়ঃসন্ধিকাল ও প্রজননস্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ বাড়ি থেকে পড়ে আসতে বলেন—এই জড়তাও কাটিয়ে উঠতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, মাসিকের সময় অনেক মেয়েই স্কুলে যায় না। ফলে তারা ৮০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারায় উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, কোনো জরিপ বা গবেষণা না থাকলেও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারী হলে সেই বিদ্যালয়ের বাথরুম পরিষ্কার থাকে। তিনি মনে করেন, বাথরুম পরিষ্কার রাখার জন্য শুধু টাকাই বড় সমস্যা নয়। কারণ এমনও নজির আছে, ১৯ কোটি টাকা তহবিলে থাকলেও সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বাথরুম নোংরা থাকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাথরুমের জানালা ছোট থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে শিক্ষাসচিব বলেন, এর ফলে আলো ঢুকতে পারে না, আবার বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলেও বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে বাল্ব থাকে না।
বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা ও অপসারণের ব্যবস্থা, প্রতিটি বিদ্যালয়ে কিচেন রাখা, হাইজেনিক ল্যাট্রিন নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো, নতুন বিদ্যালয় ভবনের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা, বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখতে আলাদা তহবিল রাখা, স্টুডেন্ট কাউন্সিল জোরদার করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন নজরুল ইসলাম খান।
সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা শাখার মহাপরিচালক জুয়েনা আজিজ বলেন, স্কুল স্যানিটেশন খাতে আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। তাহলে সংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। তিনি বলেন, এখন দরকার নজরদারি বাড়ানো। আর তা করতে পারলে এবং যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখলে স্কুল স্যানিটেশনের মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যেতে পারে।
ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ছাত্রীদের পিরিয়ডের সময়টি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর। এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলা বা সহযোগিতার জন্য বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ওই শিক্ষিকাকে প্রশিক্ষণ ও সম্মানী দেওয়ার প্রস্তাব করে তিনি বলেন, সবার উচিত মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা।
সরকারের যুগ্ম সচিব এবং স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক চৌধুরী মুফাদ আহমদ বলেন, বাথরুম থাকার পাশাপাশি এর রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। ব্যবহারের অনুপযোগী বাথরুম বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলে। তিনি মনে করেন, কোনো বিদ্যালয়ে যদি একটি বাথরুম থাকে, তবে সেটি যেন মেয়েদের ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন যাতে অপসারণের ব্যবস্থা থাকে, সেই সুযোগ রাখতে হবে। তার আগে অন্তত ঢাকনাওয়ালা ঝুড়ি রাখা উচিত। তিনি বিদ্যালয়ে ‘পিয়ার অ্যাপ্রোচ’ চালুর প্রস্তাব করে বলেন, এ ব্যবস্থায় ছেলেরা ছেলেদের এবং মেয়েরা মেয়েদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মো. হানজালা বলেন, ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ধারণা ছিল বাথরুম দূরে থাকতে হবে, যাতে গন্ধ না ছড়ায়। এর ফলে এক বদনা পানি নিয়ে ঠিকভাবে শৌচকর্ম ও হাত ধোয়া সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার আলোকে পরবর্তীকালে সমন্বিত ডিজাইন চালু করায় স্যানিটেশন-ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।
ওয়াটার এইডের দেশীয় প্রতিনিধি মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘একটি ভবন নির্মাণ করার চেয়ে এর আয়ুষ্কালে রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচ্ছন্নতার খরচ অনেক বেশি। কিন্তু আমরা শুধু একবারে বিনিয়োগ বা নির্মাণ খরচ নিয়েই ভাবি। এর ফলে ওই ভবন বা এর বাথরুম রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় টাকা সব সময় থাকে না। এ জন্য মূল প্রকল্পের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।’
বৈঠকের শুরুতে ওয়াটার এইডের পরিচালক (প্রোগ্রামস অ্যান্ড পলিসি) হাসিন জাহান ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ হাইজিন বেজলাইন সার্ভের’ প্রাথমিক প্রতিবেদনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার উপকরণ নেই। ৮৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে টয়লেট থাকলেও এগুলোর প্রায় অর্ধেক বন্ধ থাকে।
ওই প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে রাশেদা কে চৌধূরী ও নজরুল ইসলাম খান জরিপটি সহজ বাংলায় প্রকাশ ও এর প্রচার করার আহ্বান জানান।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, স্কুলের স্যানিটেশন-ব্যবস্থা দেখভাল করা জেলা বা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হওয়া উচিত।
বিভাগীয় পর্যায়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিচালিত ৬৩টি বিদ্যালয়ের স্যানিটেশন-ব্যবস্থা সন্তোষজনক উল্লেখ করে ইউসেপের নির্বাহী পরিচালক মো. জাকী হাসান বলেন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়াও সুষ্ঠুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। একটি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় তিনি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, প্রযুক্তি ব্যবহার, বাথরুম রক্ষণাবেক্ষণসহ সব কাজ করার আহ্বান জানান।
কমপক্ষে ১০টি প্রস্তাব তুলে ধরে ব্র্যাকের ওয়াশ কর্মসূচির প্রধান মিলন কান্তি বড়ুয়া বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির জন্য পৃথক তহবিল দরকার। প্রয়োজনে বছরে একবার পরিচ্ছন্নতা ফি নেওয়া যায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এ ছাড়া কমনরুমের পাশে ছাত্রীদের বাথরুম তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিদ্যালয়ের বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে ধর্মীয় নেতা ও ইমামরাও ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে করেন ইউনিসেফের আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মহসিন।
গোলটেবিল বৈঠকে সুইডিশ দূতাবাসের গ্রোগ্রাম অফিসার (স্বাস্থ্য) জহিরুল ইসলাম, সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর (শিখন) তালাত মাহমুদ ও প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শরিফুজ্জামান বক্তব্য দেন।