অস্থিরতায় শুরু হচ্ছে নতুন বছর

৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে দেশে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান এবং পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে নতুন বছর ২০১৫-এর শুরুতেই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে আজ বুধবার থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর দুদিনের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল শুরু হচ্ছে। এরপর শুক্র, শনি ও রোববার সরকারি ছুটি। আর বিএনপি জোটগতভাবে ৩ ও ৫ জানুয়ারি ঢাকায় জনসভার ঘোষণা দিয়েছে। অনুমতি না পেলে সোম ও মঙ্গলবার তাদের কর্মসূচি থাকছে। আবার ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ এবং পরদিন সমাবেশ করবে দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট। তার আগে ১ জানুয়ারি সরকারবান্ধব বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে।
এ অবস্থায় বিএনপি মাঠে কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংশয়-সন্দেহ থাকলেও সরকারি সূত্রগুলো বলছে, আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার প্রশাসনিক ও দলগতভাবে প্রস্তুত হচ্ছে। বিএনপিকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না বলে ইতিমধ্যে সরকারের একাধিক নেতা-মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন।
সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান চাঁদপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, যারা জ্বালাও-পোড়াও করে এবং অগণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, তাদের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। ৫ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশের বিষয়টি তাদের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিদ্ধান্ত নেবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর গুলশান কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে শিগগিরই একটি নতুন সংসদ নির্বানের দাবিতে সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, গাজীপুরের মতো ঢাকায়ও জনসভার অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই—এমনটা ধরে নিয়েই বিএনপি পরবর্তী কর্মকৌশল ঠিক করছে। তাদের লক্ষ্য, ৫ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করা। কর্মসূচি পালন করতে না দিলে প্রথমে হরতাল, এরপর অবরোধ কর্মসূচিতে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে বিএনপির। সেটা টানা কয়েক দিনও হতে পারে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, যত দিন এর সমাধান না হবে, তত দিন অস্থিরতা বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল, এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। নিয়ম রক্ষা তো হয়েছে। দেশের বড় একটি অংশ এবং একাধিক দেশও অপেক্ষা করছে, নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর কী ধরনের সমাধান হয়। যেহেতু এখনো সমাধান হলো না, তাই যারা সমাধান চাচ্ছে, তারা আরও সক্রিয় হবে। সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ২৭ ডিসেম্বর ‘যেকোনো মূল্যে’ গাজীপুরে জনসভা করার ঘোষণা দিয়ে শেষ মুহূর্তে পিছু হটায় দলের মাঠপর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাই ৫ জানুয়ারির কর্মসূচির বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনমনীয়। তিনি গত কয়েক দিনে দলের নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।
অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, বৃহত্তর আন্দোলনের লক্ষ্যে কৌশলগত কারণে বিএনপি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে গাজীপুরে সমাবেশ করতে যায়নি।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির টানা কর্মসূচিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৯ জানুয়ারি থেকে টঙ্গীর তুরাগতীরে দুই দফায় অনুষ্ঠেয় তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বিএনপির একটি অংশ থেকে প্রথম দফার ইজতেমা শেষ হওয়ার পর ১২ বা ১৩ জানুয়ারি থেকে টানা আন্দোলনে যাওয়ার মত আসে। কারণ, আন্দোলন শুরু করে ইজতেমার বিরতি দিলে, তখন সরকার ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করতে পারে। তবে এ মতের সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন একমত হননি। এ অবস্থায় দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, ৫ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে কর্মসূচি শক্তভাবে পালন করা। কর্মসূচি পালন করতে না দিলে হরতাল-অবরোধের দিকে যাওয়া। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা জানান, ৫ জানুয়ারি ঘিরে আন্দোলন দাঁড় করানো গেলে বা কর্মীরা ঘুরে দাঁড়ালে বিশ্ব ইজতেমার দিকে না তাকিয়ে টানা কর্মসূচিতে যাওয়ার চিন্তা রয়েছে তাঁদের।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বিএনপি কিছুদিন ধরে ‘বাঁচা-মরার’ আন্দোলনে নামার তোড়জোড় শুরু করলেও জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত খুব বেশি উৎসাহ মিলছে না। এ জন্য জামায়াতকে নিয়ে সংশয়ে আছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। এ অবস্থায় জামায়াতকে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামাতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায় থেকে চেষ্টা ও যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। গত দুই দিনে দলটির মহানগর পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান আন্দোলনে থাকা না-থাকা নিয়ে সংশয়ের বিষয়টি নাকচ করে দেন। তিনি দাবি করেন, ‘আমরা আন্দোলনে অতীতেও ছিলাম, এখনো আছি। যারা সংশয়-সন্দেহ আবিষ্কার করেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াত আন্দোলনে নামার আগেই ঢাকা মহানগরসহ জেলা পর্যায়ে জোটের লিয়াজোঁ কমিটি গঠন এবং ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করার প্রস্তাব করেছে। এর ভিত্তিতে মাঠপর্যায়ে জোটের লিয়াজোঁ কমিটি ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট একজন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সতর্ক রাখা হয়েছে। পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) পদে নিয়োগ-বদলিও সরকারের প্রশাসনিক প্রস্তুতির অংশ।
এ ছাড়া বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে জন্য সরকারের পক্ষের শক্তিগুলোও বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকছে। ১ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করবে ‘সরকারবান্ধব’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। একই স্থানে ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১৪ দলের সমাবেশ। আর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষেও রাজধানীতে বড় জমায়েত করার চিন্তা আছে আওয়ামী লীগের।
এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ঘোষণা দিয়েছেন, ৫ জানুয়ারি রাজপথ আওয়ামী লীগ দখলে রাখবে। এ ছাড়া ওই দিন ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের সতর্ক অবস্থান নেওয়ার জন্য দল থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলীয় সাংসদদের নিজ নিজ এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে।
এ অবস্থায় সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘এ ঘটনাগুলো নিঃসন্দেহে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। আমরা চাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক।’