ডা. আজহারুল হক

স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান
স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান

একাত্তরের ১৫ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনীর একটি দল ঢাকার ২২ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসের সামনে থেকে ডা. আজহারুল হককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরদিন ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের কাছে কালভার্টের নিচে তাঁর চোখ, হাত ও পা বাঁধা বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে ডা. আজহারুল হক অনন্য এক ভূমিকা পালন করেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসংলগ্ন হাতিরপুলের সাঈদা ফার্মেসিতে (বর্তমানে এ ফার্মেসি নেই) ছিল তাঁর চেম্বার। সেখানে গোপনে আসতেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি তাঁদের চিকিৎসা করতেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি তাঁদের ওষুধপথ্য দিয়েও সাহায্য করেন।
আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হকের রচনা থেকে জানা যায়, তিনি সমূহ বিপদ জেনেও অনেক রাত পর্যন্ত গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দিয়েছেন। দিনের বেলায় যথারীতি আবার হাসপাতালের ডিউটিও করেছেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসে একটি ফ্ল্যাটে আজহারুল ভাড়া থাকতেন। ১৫ নভেম্বর সকালে তিনি জানতে পারেন, আলবদর বাহিনী ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসহ আশপাশ এলাকায় আগের রাত থেকে কারফিউ জারি করে রেখেছে। কর্তব্যপরায়ণ আজহারুল হক হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলেন। এরপর বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই ভবনের আরেক ভাড়াটে ডা. হুমায়ুন কবীর।
হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে নিতে আসে। কিন্তু হাতিরপুলের রাস্তায় টহলরত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওই অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি। পরে কয়েকজন আলবদর সদস্য বাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁদের দুজনকে ধরে নিয়ে যায়।
আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক তাঁর রচনায় লিখেছেন, ‘...আমাদের বাসার গেটের কাছে যে তেঁতুলগাছটি, সেখানে দাঁড়িয়ে আজহার ও হুমায়ুন কবীরের সাথে আলবদররা কথা বলছিল, সামনের তিনতলা বিল্ডিংয়ের ভাড়াটে ভদ্রলোক উপর থেকে সব প্রত্যক্ষ করেছেন। এ দৃশ্য ঝাপফেলা কয়েকজন দোকানিও ঝাপের ফুটা দিয়ে দেখেছেন। কিন্তু দূরত্বের জন্য কী কথাবার্তা হচ্ছিল, তা আর কেউ বুঝতে পারেনি। তবে একপর্যায়ে আজহার তেঁতুলগাছে হাত ঠেস দিয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখন ওরা ডাক্তারের হাতের ডানায় রাইফেল দিয়ে মারে। ডাক্তার তখন থতমত খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং মুখটা নাকি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সাথে সাথে কয়েকজন এসে সামনে-পিছনে রাইফেল তাক করে তাঁদের দুজনকে তেঁতুলগাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জিপ গাড়িতে তোলে। সেই গাড়িতে নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারি লোকটি ছিল। সে লোকই নাকি সে সময় দালালি করত।
‘...শুনেছি নরপশুরা ডাক্তারকে কোনো গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল। এই কি সহ্য করা যায়? কী যন্ত্রণা, কী কষ্টই না দিয়ে ওর তরতাজা ৩১ বছরের জীবনটা বের করেছে।’ (আমার স্বামী, স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
আজহারুল হকের জন্ম ঢাকায় ২ মার্চ, ১৯৪০। তাঁর আদিনিবাস পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর। বাবা জহুরুল হক, মা ফাতেমা খাতুন। দুই বছর বয়সে বাবা মারা যান। তখন তাঁর বাবা ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। তিনি ১৯৬৮ সালে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে খুব ভালো ফল করে এমবিবিএস পাস করেন। এক বছরের ইন্টার্নি শেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহকারী শল্যচিকিৎসক পদে নিযুক্ত হন।

নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক আজহারুল হকের একমাত্র পুত্রসন্তান স্বাধীনতার এক মাস পর ১৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম আশরাফুল হক নিশান।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী—২৩
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

ডা. আজহারুল হক
একাত্তরের ১৫ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনীর একটি দল ঢাকার ২২ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসের সামনে থেকে ডা. আজহারুল হককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরদিন ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের কাছে কালভার্টের নিচে তাঁর চোখ, হাত ও পা বাঁধা বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে ডা. আজহারুল হক অনন্য এক ভূমিকা পালন করেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসংলগ্ন হাতিরপুলের সাঈদা ফার্মেসিতে (বর্তমানে এ ফার্মেসি নেই) ছিল তাঁর চেম্বার। সেখানে গোপনে আসতেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি তাঁদের চিকিৎসা করতেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি তাঁদের ওষুধপথ্য দিয়েও সাহায্য করেন।
আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হকের রচনা থেকে জানা যায়, তিনি সমূহ বিপদ জেনেও অনেক রাত পর্যন্ত গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দিয়েছেন। দিনের বেলায় যথারীতি আবার হাসপাতালের ডিউটিও করেছেন।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসে একটি ফ্ল্যাটে আজহারুল ভাড়া থাকতেন। ১৫ নভেম্বর সকালে তিনি জানতে পারেন, আলবদর বাহিনী ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসহ আশপাশ এলাকায় আগের রাত থেকে কারফিউ জারি করে রেখেছে। কর্তব্যপরায়ণ আজহারুল হক হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলেন। এরপর বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই ভবনের আরেক ভাড়াটে ডা. হুমায়ুন কবীর।
হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে নিতে আসে। কিন্তু হাতিরপুলের রাস্তায় টহলরত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওই অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি। পরে কয়েকজন আলবদর সদস্য বাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁদের দুজনকে ধরে নিয়ে যায়।
আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক তাঁর রচনায় লিখেছেন, ‘...আমাদের বাসার গেটের কাছে যে তেঁতুলগাছটি, সেখানে দাঁড়িয়ে আজহার ও হুমায়ুন কবীরের সাথে আলবদররা কথা বলছিল, সামনের তিনতলা বিল্ডিংয়ের ভাড়াটে ভদ্রলোক উপর থেকে সব প্রত্যক্ষ করেছেন। এ দৃশ্য ঝাপফেলা কয়েকজন দোকানিও ঝাপের ফুটা দিয়ে দেখেছেন। কিন্তু দূরত্বের জন্য কী কথাবার্তা হচ্ছিল, তা আর কেউ বুঝতে পারেনি। তবে একপর্যায়ে আজহার তেঁতুলগাছে হাত ঠেস দিয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখন ওরা ডাক্তারের হাতের ডানায় রাইফেল দিয়ে মারে। ডাক্তার তখন থতমত খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং মুখটা নাকি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সাথে সাথে কয়েকজন এসে সামনে-পিছনে রাইফেল তাক করে তাঁদের দুজনকে তেঁতুলগাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জিপ গাড়িতে তোলে। সেই গাড়িতে নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারি লোকটি ছিল। সে লোকই নাকি সে সময় দালালি করত।
‘...শুনেছি নরপশুরা ডাক্তারকে কোনো গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল। এই কি সহ্য করা যায়? কী যন্ত্রণা, কী কষ্টই না দিয়ে ওর তরতাজা ৩১ বছরের জীবনটা বের করেছে।’ (আমার স্বামী, স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
আজহারুল হকের জন্ম ঢাকায় ২ মার্চ, ১৯৪০। তাঁর আদিনিবাস পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর। বাবা জহুরুল হক, মা ফাতেমা খাতুন। দুই বছর বয়সে বাবা মারা যান। তখন তাঁর বাবা ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। তিনি ১৯৬৮ সালে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে খুব ভালো ফল করে এমবিবিএস পাস করেন। এক বছরের ইন্টার্নি শেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহকারী শল্যচিকিৎসক পদে নিযুক্ত হন।
নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক আজহারুল হকের একমাত্র পুত্রসন্তান স্বাধীনতার এক মাস পর ১৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম আশরাফুল হক নিশান।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান