প্রস্তুতি ছাড়াই ৬ মেডিকেলের যাত্রা শুরু আজ

মৌলিক অবকাঠামো ছাড়াই নতুন ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এসব কলেজে এখনো প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার এই ছয়টি মেডিকেল কলেজসহ সেনা সদর দপ্তরের অধীন পাঁচটি নতুন আর্মি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন ছয় সরকারি কলেজে প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের হোস্টেল তৈরি হয়নি। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর মেডিকেল কলেজগুলো চালু হচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্য করছে সরকার। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১তে বলা আছে, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য নিজস্ব জমিতে পৃথক ভবনে হাসপাতাল ও একাডেমিক কার্যক্রম চালাতে হবে। সাময়িকভাবেও ভাড়া বাড়িতে কলেজ বা হাসপাতাল করা যাবে না। ৫০ আসনের কলেজের জন্য ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল থাকতে হবে। কিন্তু সরকারি কলেজ স্থাপনের জন্য এ রকম নীতিমালা নেই।’
মেডিকেল শিক্ষাসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, দেশে চিকিৎসকের চাহিদা কত তা নিরূপণ করার পর সব ধরনের প্রস্তুতি শেষে নতুন কলেজ চালু করা উচিত ছিল।
পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজ চালুর ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক আবু শফি আহমেদ আমিন বলেন, আশা করা যায় ১০ বছরের মধ্যে এসব কলেজের অবকাঠামো নির্মাণসহ সব কাজ শেষ হবে এবং পূর্ণোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চলবে।
নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো হচ্ছে টাংগাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, পটুয়াখালী ও রাঙামাটি জেলায়। সেনা সদর দপ্তরের অধীন আর্মি মেডিকেল কলেজগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, যশোর, রংপুর, বগুড়া ও কুমিল্লা সেনানিবাসে।
নতুন ছয়টি নিয়ে দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৯টিতে। আর্ম ফোর্সেস মেডিকেল কলেজসহ সেনা সদর দপ্তরের অধীন কলেজের সংখ্যা হলো ছয়টি। এ ছাড়া আছে ৬৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। এই ৯৮টি মেডিকেল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে।
বাস্তব পরিস্থিতি: সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজগুলোর অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, জামালপুর মেডিকেল কলেজে ক্লাস হবে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কোয়ার্টারে ও একটি টিনের ছাউনি দেওয়া ভবনে। সিরাজগঞ্জে ক্লাস হবে সড়ক দুর্ঘটনায় জরুরি চিকিৎসার জন্য তৈরি করা ‘ট্রমা সেন্টারের’ দ্বিতীয় তলায়। টাংগাইলেও সরকারি ‘ট্রমা সেন্টারে’ ক্লাস বসবে। মানিকগঞ্জে ক্লাস হবে সরকারি নার্সিং কলেজের একটি অংশে। রাঙামাটি সদর হাসপাতালে নতুন তৈরি করা করোনারি কেয়ার ইউনিটে মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে চলবে সেখানকার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লাস।
প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াই এসব কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, পুরাতন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতেই শিক্ষক দেওয়া যাচ্ছে না। একাধিক কলেজে দীর্ঘদিন অনেক পদ খালি আছে। নতুন কলেজেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক দেওয়া সম্ভব হবে না।
জামালপুর মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষসহ আটজন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। মানিকগঞ্জে সব চেয়ে বেশি শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন, ১৪ জন। রাঙামাটি কলেজের প্রকল্প পরিচালক শহীদ তালুকদার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এই কলেজের জন্য এখনো কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এম এ মান্নান জানান, তিনিসহ তিনটি বিভাগের প্রধান নিয়োগ পেয়েছেন। বাকি নিয়োগ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করা হয়নি। আর টাংগাইলে অধ্যক্ষসহ সাতজন নিয়োগ পেয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের জেলা সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজে নিয়োগ পেয়েছেন সব চেয়ে কম, চারজন শিক্ষক।
মেডিকেল শিক্ষার ধরনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের পৃথক আবাসন ব্যবস্থা থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই ছয়টি মেডিকেল কলেজের একটিতেও তা নেই। এসব কলেজে ভাড়া বাড়িতে, চিকিৎসকদের কোয়ার্টারে বা নার্সদের হোস্টেলে নতুন শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনবল) এ বি এম আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় আবাসন ও অন্যান্য সমস্যা দূর করার চেষ্টা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে বাকি সমস্যাগুলো দূর করা হবে।
তবে আবদুল হান্নানের কথার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল নেই। চার বছর আগে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ যাত্রা শুরু করেছিল। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক নিজের জেলায় এই সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই হাসপাতালে এখন চারটি শিক্ষাবর্ষের ২০০-এর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এখনো একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন তৈরির উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। কলেজ চলছে সদর হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনগুলোতে। যতজন শিক্ষক প্রয়োজন আছে তার এক-তৃতীয়াংশ। কলেজের পৃথক কোনো হাসপাতাল নেই। ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালকেই কলেজের হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজ। এ পর্যন্ত ইন্টার্নশিপ শেষ করে চিকিৎসক হয়ে বের হয়েছেন প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা, আর দ্বিতীয় ব্যাচ বের হওয়ার পথে। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কলেজের একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন এবং হোস্টেল নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এই কলেজে শিক্ষকের পদ আছে ৮৮টি। শিক্ষক আছেন ৬০ জন। একমাত্র অধ্যক্ষ ছাড়া এই কলেজে অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো শিক্ষক নেই। একটি বিভাগ চালাচ্ছেন শুধু প্রভাষকেরা।
পাঁচ আর্মি মেডিকেল কলেজ: চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও কুমিল্লার আর্মি মেডিকেল কলেজগুলো অস্থায়ী ভবনে শুরু হচ্ছে। বগুড়ায় সামরিক-অসামরিক ১৩ জন শিক্ষক, রংপুরে ২০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার শিক্ষকদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। আর যশোর আর্মি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ সেনা সদর দপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জামালপুর, টাংগাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাঙামাটি, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লা, রংপুর ও বগুড়া প্রতিনিধি।)