ঔষধ প্রশাসনে অধিদপ্তরে ঘুষ লেনদেন ১৫ লাখ পর্যন্ত

.
.

নতুন প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধের ছাড়পত্র নবায়ন করা পর্যন্ত ১৩টি খাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫০০ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আজ বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। 

রাজধানীর মাইডাস ভবনে ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওষুধ উৎপাদনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অধিদপ্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তার অসাধু সম্পর্ক রয়েছে। ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে নজরদারির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি আছে। রাজনৈতিক প্রভাবে কমিটিগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওষুধ উৎপাদনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশীয় বাজারের জন্য কম মানসম্পন্ন ও রপ্তানির জন্য বেশি মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আছে। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে টিআইবি যোগাযোগ রেখেছে। এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের কথা অধিদপ্তর স্বীকার করেছে। তবে টাকার অঙ্ক নিয়ে তাঁরা দ্বিমত পোষণ করেছেন।’
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীলতার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অধিদপ্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ একই। যাঁর যে কাজ করার কথা, তিনি সে কাজ করছেন না বা করতে পারছেন না।

টিআইবি বলছে, অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। পাশাপাশি ওষুধ উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানও অসাধু কাজ করছেন না। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অধিদপ্তরে দক্ষ ও যোগ্য লোকবল নিয়োগের প্রস্তাব করেছে।
গবেষণা প্রতিবেদন তৈরির সময় (মার্চ ২০১৪-জানুয়ারি ২০১৫) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক উদ্যোগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


টাকা লেনদেনের খাত

আজ গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মো. শাহনূর রহমান ও নাজমুল হুদা মিনা। তাঁরা বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সবচেয়ে বেশি টাকার লেনদেন হয় কোনো প্রকল্প স্থানান্তর বা হস্তান্তরের সময়। এ ক্ষেত্রে একেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র পেতে ৫ থেকে ১০ লাখ, লাইসেন্স নবায়ন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ, রেসিপি অনুমোদন ৪-৫ হাজার, ওষুধ নিবন্ধন ১ থেকে দেড় লাখ, ফয়েল, ইনসার্ট, লেবেল অনুমোদন ৭-৯ হাজার, ব্লকলিস্ট অনুমোদন ২ থেকে আড়াই হাজার, লিটারেচার অনুমোদন ৪-৫ হাজার, দাম নির্ধারণ ৫-৬ হাজার, ওষুধ রপ্তানির নিবন্ধন ও জিএমপি সনদ ২০-৩০ হাজার, নমুনা পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ৬-৭ হাজার, ওষুধের লাইসেন্স ১০-১৫ হাজার ও ওষুধের লাইসেন্স নবায়নে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন হয়।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠ পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কর্মকর্তারা সরকারি আইন ভঙ্গ করে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। কে কী কাজ করবেন, সে বিষয়ে মহাপরিচালক বা পরিচালকেরা তাঁদের ইচ্ছেমতো দায়িত্ব বণ্টন করে থাকেন। অনেক সময় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পছন্দমতো কর্মকর্তাদের কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ফলে সমঝোতামূলক দুর্নীতির ঘটনা ঘটে থাকে। মাঠ পর্যায়ে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি এবং খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো অভিযানের নির্দেশ থাকলেও মোবাইল ফোনে অনেক কর্মকর্তা কাজ সারেন বলে মন্তব্য করা হয়।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের সময় তাঁরা অধিদপ্তরের বর্তমান ও সাবেক ৩৫ কর্মকর্তা, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন, অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কমিটির পাঁচজন, ওষুধ দোকানের মালিক ৩৫ জন, ওষুধ খাত বিশেষজ্ঞ ৮ জন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের দুজন, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির ৪ জনের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে ১০টি দলগত আলোচনা, কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ৪টি ওষুধ কারখানা, ঢাকার জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার ও চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় ওষুধ পরীক্ষাগারের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন।
টিআইবি ওষুধ আইন ১৯৪০ ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২ যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করেছে। কারণ, এ আইনের আওতায় মেডিকেল ডিভাইস, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত নেই।