বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছেন বিদেশি পর্যটকেরা

প্রতিবছর যুক্তরাজ্যের ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ নাগরিক বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে দেশটির ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস (এফসিও) বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে।
বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কেবল যুক্তরাজ্য নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছেন। এর ফলে দেশের পর্যটন খাতে ধ্বংস নেমে আসতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। ২০১৩ সালেও এখনকার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানায় টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটন মৌসুমে স্বাভাবিক সময়ে দেশের ভেতরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ পর্যটক বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে। কিন্তু টানা হরতাল, অবরোধ ও নাশকতায় অভ্যন্তরীণ পর্যটনও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, কোথাও এখন পর্যটক নেই। ফলে এই খাতের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১০ লাখ মানুষও সংকটে পড়েছে। অনেক টুর অপারেটর ও হোটেল মালিক পর্যটক না পেয়ে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
টোয়াবের সাবেক সভাপতি এবং বেসরকারি টুর অপারেটর জার্নি প্লাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুল হক বলেন, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যটন মৌসুম। কিন্তু টানা অবরোধের কারণে বিদেশি পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে দেশ। এরই মধ্যে কয়েক হাজার বিদেশি তাদের পূর্বনির্ধারিত ভ্রমণ বাতিল করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে আমাদের কয়েক শ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। ভবিষ্যতের পর্যটনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ বেঙ্গল টুরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেনও একই রকম তথ্য দেন।
টোয়াবের পরিচালক তৌফিক রহমান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এফসিও তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে বলেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা। এ ছাড়া তারা সাম্প্রতিক সময়ের ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলাসহ সব ঘটনাই তুলে দিচ্ছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের একই ধরনের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের অনুরোধ, তারা যেন পর্যটন খাতকে রাজনৈতিক সহিংসতার বাইরে রাখে।’
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড (বিপিটি) ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৭ জন এবং ২০১২ সালে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৩ জন বিদেশি পর্যটক এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার বছর ২০১৩ সালে এই সংখ্যা আড়াই লাখে নেমে এসেছিল। এবারও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ২ দশমিক ১০ শতাংশ। আর এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ লোকের। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ জন সরাসরি পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, আগামী এক দশকে পর্যটন খাতে যে ১২টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ তার অন্যতম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এই সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিদেশি পর্যটক অর্ধেকে নেমে আসে। ২০১৪ সালে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেও ২০১৫ সালে এসে আবার সেই একই পরিস্থিতি। কেবল বিদেশি নয়, প্রতিবছর এই সময় দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও খুব ভিড় থাকে। কিন্তু অবরোধে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আসলেই পর্যটন খাত ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। আমরা এই খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীসহ সবাইকে নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি, তারা যেন দেশের স্বার্থে পর্যটন খাতকে অবরোধের বাইরে রাখেন।’