পাঁচ বছরে একজন সাক্ষীও হাজির হননি

সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলার বিচারকাজ এগোচ্ছে না। প্রায় দুই যুগ ধরে চলছে এ অবস্থা। গত পাঁচ বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করতে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিত এ ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালে আইনজীবী শহীদুল হুদা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদাসহ ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট এ মামলায় হাফিজ উদ্দিন দেওয়ান নামের এক পুলিশের সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছিল। এর আগে ২০১৪ সালে পাঁচ কার্যদিবসে এবং ২০১৩ সালে আট কার্যদিবসে কোনো সাক্ষীকে হাজির করা যায়নি। সর্বশেষ গত ১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেন আদালত। এভাবে পাঁচ বছর ধরে একজন সাক্ষীকেও হাজির করতে পারছে না পুলিশ। গত ২৩ বছরে ১৬৮ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে।
আদালত সূত্র জানায়, সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় ২০১৪ সালে এ মামলার বিচারক এক আদেশে উল্লেখ করেন, ‘১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারা অনুযায়ী সাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশ কর্মকর্তার। সাক্ষীর অভাবে মামলা প্রমাণ করা না গেলে দায় পুলিশকে বহন করতে হবে।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, মামলার সাক্ষী ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, ২৭ বছরেও মামলাটির বিচার না হওয়া দুঃখজনক। সাক্ষীদের হাজির করে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্যোগী হওয়া উচিত। প্রয়োজনে দ্রত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তর করে বিচার শেষ করা হোক।
এ মামলার আরেক সাক্ষী সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি আদালতে হাজির হতে কোনো সমন পাইনি। কীভাবে সাক্ষ্য দিতে যাব।’
এ মামলার বিচারের শেষ দেখে যেতে পারেননি বাদী শহীদুল হুদাও। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। হতাশ হয়ে পড়েছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও। নিহত অ্যাথেল গোমেজের কন্যা পাপড়ি গোমেজ জানান, তাঁর জন্মের দুই দিন পরই পিতা অ্যাথেল গোমেজ মারা যান। তাঁর মা লুচিয়া গোমেজও বিচার প্রক্রিয়ার শেষ দেখে যেতে পারেননি। ছয় বছর আগে মারা গেছেন তিনিও। নির্বিচারে গুলি চালানো পুলিশদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান পাপড়ি।
২৪ জানুয়ারি নিহত নেতা-কর্মীদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের ফটকে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি সিআইডি অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ নারাজি জানালে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০০ সালের ৯ মে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আসামিদের সবাই পুলিশ। এর মধ্যে পুলিশের পরিদর্শক গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল শুরু থেকে পলাতক রয়েছেন। অন্য পাঁচ আসামি পুলিশের হাবিলদার প্রদীপ বড়ুয়া, কনস্টেবল মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ, তৎকালীন নগর পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা ২০০৩ সাল থেকে জামিনে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ধর। অন্য দুই আসামি কনস্টেবল বশির আহমেদ ও আবদুস সালাম জামিনে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অশোক কুমার দেব জানান, এ মামলার সাক্ষীদের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু রয়েছেন। তবে তাঁদের সাক্ষ্য না নিলেও আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে। চিকিৎসকসহ আর কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা হবে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মামলাটি স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের আমলে সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় বিচার ঝুলে আছে। সাক্ষীদের হাজির করতে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
আাদলত সূত্র জানায়, ১৬৮ সাক্ষীর মধ্যে ৪৮ জন পুলিশ। এর মধ্যে মাত্র নয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। চিকিৎসক সাক্ষী রয়েছেন ১২ জন। সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র তিনজন। সুরতহালের সাক্ষী ১২ জনের মধ্যে দিয়েছেন চারজন।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, সাক্ষীদের ঠিকানায় গিয়ে তাঁদের পাওয়া না যাওয়ায় হাজির করা যাচ্ছে না। তাদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা চলছে।