পোড়া রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই ঢাকার বাইরে

১৩ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট, কিন্তু নেই প্রশিক্ষিত জনবল, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেলে
১৩ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট, কিন্তু নেই প্রশিক্ষিত জনবল, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেলে

প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে আগুনে পোড়া রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার কেন্দ্র আছে মাত্র একটি। এটি হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। ফলে রোগীদের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে এই ইউনিটকে।
আরও ১৩টি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট থাকলেও সেগুলোতে জনবল ও চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই এগুলো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা দিতে পারছে না। গুরুতর দগ্ধ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। এতে স্থানান্তরকালীন রোগীর মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যত্র পূর্ণাঙ্গ ও ভালো চিকিৎসাসুবিধা না থাকার কারণে গত বছর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দিতে হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার রোগীকে। রোগীর চাপের কারণে এই বার্ন ইউনিটে সংক্রমণের ঝুঁকি এবং সংক্রমণে মৃত্যুর হারও বেশি। এই চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত জনবলেরও রয়েছে তীব্র সংকট।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো শিশু ১০ শতাংশ ও কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ১৫ শতাংশ পোড়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন। নইলে রোগীর কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা।
জানা গেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি চিকিৎসার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান করার কথা বলা হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা এখনো হয়নি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট অনুমোদন করে। এ-সংক্রান্ত ফাইল এখন আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, বার্ন ইউনিটকে ইনস্টিটিউট করার একটা প্রস্তাব এসেছে। বিধিবিধানের আলোকে সবকিছু বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ২৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৬৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ৪৬৪টি উপজেলায় আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা দরকার। দেশের চাহিদা পূরণে এই মুহূর্তে ১ হাজার ৫৫১ জন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন দরকার। এখন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ৫০ জন। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এই বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে আরও ১০০ জন বিশেষজ্ঞ তৈরি হতে সময় লাগবে আরও ৫০ বছর।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট সূত্র জানায়, এখানে রোগীর চাপের কারণে গত নভেম্বরে ২৩ শতাংশ রোগী সংক্রমণের শিকার হয়। সংক্রমণের কারণে রোগী মৃত্যুর পাশাপাশি রোগীদের সেরে উঠতেও অনেক সময় লাগছে। ১৮ ডিসেম্বর ইউনিটের পাঁচতলার বারান্দায় ৪২ জন রোগী ছিলেন। এঁদের মধ্যে ১১ মাসের পুরোনো রোগীও ছিলেন।
আশির দশকের প্রথম ভাগেও দগ্ধ রোগীদের জন্য ঢাকা মেডিকেলে কোনো ইউনিট ছিল না। পোড়া রোগীদের জায়গা হতো হাসপাতালের বারান্দায়। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে ছয়টি শয্যা নিয়ে দেশে প্রথম বার্ন ইউনিট চালু হয় ঢাকা মেডিকেলে। ইউনিটটি ৫০ শয্যা করা হয় ১৯৯৬ সালে। আরও ৫০ শয্যা বাড়তে সময় লাগে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ সালে সরকার ইউনিটটিকে ইনস্টিটিউট করে ৩০০ শয্যা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ইউনিটের জনবল ১০০ শয্যার, ওষুধপথ্যের জোগানও ১০০ জনের হিসাবে। বাকিটুকু চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদান নিয়ে।
ইউনিটের চিকিৎসকেরা আক্ষেপ করে বলেন, বড় কোনো দুর্যোগের সময় বার্ন ইউনিটের সংকট কাটানোর একটা চেষ্টা দেখা যায়, তারপর আবার সবাই ভুলে যায়।
অন্য ১৩ বার্ন ইউনিটে অপ্রতুলতা: একপর্যায়ে সরকারের নির্দেশনায় রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ফরিদপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট চালু করা হয়। অপ্রতুল দক্ষ জনবল ও সুবিধা নিয়ে এগুলো চালু হয়। চালুর অল্প দিন পর দিনাজপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহের ইউনিট জনবলের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে দগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য ইউনিট চালু হলেও প্রচারের অভাবে সেখানে রোগী যায় কম। গত রোববার সেখানে গিয়ে জানা যায়, হরতাল-অবরোধে দগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য পাঁচটি শয্যা আলাদা করে রাখা হলেও একজন রোগীও যাননি। অন্যদিকে রোববার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে গেছেন এমন ৮৬ জন দগ্ধ রোগী। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের প্রধান আহমেদ সিরাজী বলেন, যাঁরা কিছুটা কম পুড়েছেন, তাঁদের চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেলে না গেলেও চলে। তবে শ্বাসতন্ত্র পুড়ে গেলে রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র দরকার হয়। এখানে চার শয্যার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকি বার্ন ইউনিটগুলোর বেশির ভাগই গুরুতর দগ্ধ রোগীকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। যেমন ময়মনসিংহের সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক সিদ্দিক, কুমিল্লার ট্রাকচালক পিয়ার আহমদ, রাজশাহীর ট্রাকচালক সিদ্দিক, বগুড়ার সাজু, সিলেটের ট্রাকচালক বকুল দেবনাথ ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।
সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. আবদুস সালাম জানান, আলাদা ইউনিট হলেও হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা নেই। তাঁরা থাকছেন সার্জারি ওয়ার্ডের শয্যায়। এ মুহূর্তে হরতাল-অবরোধে দগ্ধ পাঁচজন রোগী চিকিৎসাধীন। তবে এঁদের কারও অবস্থা গুরুতর নয়। গুরুতর হওয়ায় বকুল দেবনাথকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এত জটিল রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁদের ইউনিটে মাত্র একজন সহকারী অধ্যাপক ও পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন।
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলেও একই হাল। আলাদা ইউনিট হলেও প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামো নেই। দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা হয় সার্জারি ওয়ার্ডে। একজন সহকারী অধ্যাপক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের সহযোগিতায় দগ্ধ রোগীদের প্রাথমিক সেবা দিয়ে ঢাকায় পাঠান।
রংপুর মেডিকেলে ইউনিটটি চালান সহকারী অধ্যাপক মো. মারুফুল ইসলাম, দুজন রেজিস্ট্রার ও দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার। মো. মারুফুল ইসলাম বলেন, সব যন্ত্রপাতি থাকলেও চিকিৎসক কম থাকায় রোগীদের সেবা দেওয়া খুব কষ্টকর। ১৬টি শয্যা, গড়ে রোগী আসে ৪০ জন। রোগী বেশি হলে সার্জারি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। হাসপাতালের পরিচালক আবদুল কাদের খান বলেন, অন্য ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গে থেকে পোড়া রোগীরা সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে বার্ন ইউনিটে একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, সাতজন মেডিকেল অফিসার ও ১৫ জন নার্স রয়েছেন। তবে দগ্ধ রোগীদের জন্য কোনো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। তাই গুরুতর দগ্ধ রোগীকে চট্টগ্রামে রাখা হয় না। পোড়া কম হলেই রাখা হয়। ২৭ শয্যার ইউনিটে শুক্রবার ভর্তি ছিলেন ৬৭ জন। বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মৃণাল কান্তি দাশ বলেন, ‘জনবল খুবই কম। আইসিইউ নেই বলে জটিল রোগী রাখা হয় না।’
রাজশাহী মেডিকেলে দগ্ধ রোগীদের জন্য শয্যা ২৪টি। পাঁচজনের চিকিৎসক দলে বিশেষজ্ঞ একজন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে সার্জারি ইউনিটের অধীন ১০টি বিছানা আছে। জরুরি ও জটিল রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে নেই বলে জানান সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রতন কুমার সাহা। খুলনা মেডিকেলের পরিচালক আবদুস সামাদ জানান, ২০ শয্যার ইউনিটের অনুমোদন হয়েছে মাস দুয়েক আগে। চারজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু অবকাঠামোগত দুর্বলতা থাকায় জরুরি রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যায় না।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী), আরিফুল হক (রংপুর), প্রণব বল (চট্টগ্রাম), সুমনকুমার দাশ (সিলেট) ও পান্না বালা (ফরিদপুর)}।