দ. আফ্রিকায় খুন, লুটপাটে আতঙ্কে বাংলাদেশিরা

দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় চলতি জানুয়ারি মাসে অন্তত সাতজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। পাঁচ শতাধিক দোকানে লুটপাট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্কে আছেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
দক্ষিণ আফ্রিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকজন জানিয়েছেন, দেশটিতে প্রায়ই বাংলাদেশিদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৯ জানুয়ারি জোহানেসবার্গের কাছে সোয়েটা এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত ডাকাতি করতে এলে সোমালিয়ার লোকজন গুলি চালায়। এতে ১৪ বছরের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে মারা যায়। ওই ঘটনার জন্য বিদেশিদের দায়ী করে কৃষ্ণাঙ্গরা সোয়েটায় ব্যাপক হামলা ও লুটপাট চালায়। এতে বাংলাদেশিরা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুই দিন পর দূতাবাসের কর্মকর্তারা পুলিশ নিয়ে এসে তাঁদের উদ্ধার করেন।
আরেক ঘটনায় ১৯ জানুয়ারি ক্রিস্টিনা এলাকায় সিলেটের ফয়সাল আহমেদকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন আরেক হামলায় নিহত হন ঢাকার রমজান হোসেন। ২০ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জের মনিরুল ইসলামকে বিসমার্ক নিলেজ এলাকায় হত্যা করা হয়। ২৩ জানুয়ারি টুইফন্টেইনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ইকরাম উদ্দিন এবং ২৬ জানুয়ারি রাস্টেনবার্গ এলাকায় ফেনীর দাগনভূঞার বেলায়েত হোসেনকে হত্যা করা হয়। ১৭ জানুয়ারি কুমিল্লার সোহেল রানা এবং ১০ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের আক্তার হোসেনকে হত্যা করা হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর আরেক হামলায় নিহত হন লুৎফর রহমান।
বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪৩৯ জন বাংলাদেশির লাশ এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল—এই সময়ে মোট ৪৫৮ জনের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের বেশির ভাগই হত্যার শিকার হয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, যাঁরা খুন হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দোকানমালিক ও ব্যবসায়ী। ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হামলার পরই এসব খুনের ঘটনা ঘটছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা চরম উদ্বেগের মধ্যে আছেন।
নিহত ইকরাম উদ্দিনের চাচা মোকছেদুল আলম প্রথম আলোকে জানান, ছয় বছর আগে ইকরাম দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। সেখানে দোকান চালাতেন। ২৩ জানুয়ারি দুর্বৃত্তরা টিন কেটে দোকানে ঢুকে সব লুট করে নিয়ে যায় এবং তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ২৮ জানুয়ারি তাঁর লাশ দেশে এসেছে।
নিহত সোহেলের পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার সুযোগে সেখানে যান সোহেল। তিনি তাঁর খালুর দোকানে চাকরি করতেন। ১৭ জানুয়ারি রাতে সন্ত্রাসীরা দোকানে এসে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ কল্যাণ পরিষদের আহ্বায়ক কামালউদ্দিন গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘাত বেড়ে গেছে। আর এর শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সোয়েটায় বাংলাদেশি দোকানদারেরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অন্যান্য জায়গায়ও আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করছেন বাংলাদেশিরা।’
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, বৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার সুযোগ খুব কম। কিন্তু একশ্রেণির দালাল ছয়-সাত লাখ টাকা নিয়ে মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, লাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় লোক পাঠায়। এভাবে যাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যান, তাঁদের বেশির ভাগেরই বাড়ি নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও মুন্সিগঞ্জে। তাঁদের বেশির ভাগ দোকান চালান। কিন্তু তাঁরা বৈধ নন। ফলে তাঁদের ব্যাংক হিসাব নেই। এ কারণে নিজেদের কাছেই তাঁরা নগদ টাকা রাখেন। আর ওই টাকা ছিনিয়ে নিতেই এসব হামলা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাংলাদেশ হাইকমিশন বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তাদের কাছে এসব ঘটনার প্রতিকার ও ন্যায়বিচার চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশি খুনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার দাউদ আলী গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোয়েতায় কৃষ্ণাঙ্গ এক কিশোর মারা যাওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, সোমালীয় ও ইথিওপিওদের দোকানে বেপরোয়া লুটপাট হয়েছে। খবর পাওয়ার পরপরই দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা সেখানে গেছেন। কিন্তু প্রথম দিন পুলিশ ঢুকতে পারেনি। পরে পুলিশ সেখানে ঢুকেছে। আমরা ৫০-৬০ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি।’
হতাহত বাংলাদেশিদের বিষয়ে জানতে চাইলে দাউদ আলী বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে আমরা ১৪ জন বাংলাদেশির লাশ দেশে পাঠিয়েছি। এর মধ্যে পাঁচজন স্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন। বাকি নয়জনই অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন। এই মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশিদের সতর্ক হয়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশকে আমরা সব জানিয়েছি। পুলিশও আসামিদের ধরতে তৎপর আছে।’