তিনজনের দেহে ৫৪ গুলি, পুলিশ বলছে গণপিটুনি

গুলির খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে ঘটনাস্থলে। পুলিশের ভাষ্য, মিরপুরের কাজীপাড়ার এখানেই তিনজনকে গণপিটুনি দিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে স্থানীয়রা l ছবি: প্রথম আলো
গুলির খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে ঘটনাস্থলে। পুলিশের ভাষ্য, মিরপুরের কাজীপাড়ার এখানেই তিনজনকে গণপিটুনি দিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে স্থানীয়রা l ছবি: প্রথম আলো

নিহত তিন তরুণের দেহে মোট গুলির চিহ্ন ৫৪টি। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনেই এত গুলির চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পিটুনির কোনো চিহ্ন নেই। এলাকাবাসীও বলছেন, গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। অথচ পুলিশের দাবি, তাঁরা গণপিটুনি ও গুলিতে নিহত হয়েছেন।
রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায় গত রোববার রাতে এই তিন তরুণ নিহত হন। পুলিশ তাঁদের ‘নাশকতাকারী’ দাবি করলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি।
রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আবদুল ওদুদ ব্যাপারীর (২৬) স্বজনদের দাবি, তিনি রাজনীতি করতেন না। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।
এদিকে গতকাল সকালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডেফলবাড়িয়া গ্রাম থেকে দুই যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ কয়েক দিন আগে তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জেলা বিএনপির দাবি, নিহত দুজন বিএনপির কর্মী ছিলেন।
তিনজনের দেহে ৫৪ গুলি: রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তিন তরুণের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় মিরপুর থানার পুলিশ। ওই তিনজনের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী এলাকায় রোববার রাত পৌনে ১০টা থেকে ১০টার মধ্যে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ সূত্র জানায়, ময়নাতদন্তে তাঁদের শরীরে মারধরের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সুরতহাল প্রতিবেদনে মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ পারভেজ উল্লেখ করেন, তিনজনের মধ্যে একজনের দেহে ২২টি, একজনের দেহে ১৭টি এবং অপরজনের দেহে ১৫টি গুলির ক্ষত (মোট ৫৪টি) রয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী বলেও সুরতহালে উল্লেখ করা হয়।
সুরতহাল প্রতিবেদনে ‘প্রাথমিক তদন্তের’ বরাত দিয়ে বলা হয়, নিহত তিনজন কয়েকজন সহযোগীসহ কাজীপাড়ার কৃষিবিদ ভবনের সামনে ককটেল, পেট্রল, পেট্রলবোমাসহ নাশকতার জন্য অবস্থান করলে জনতা তাঁদের ধাওয়া দেয়। বাইশবাড়ী এলাকায় তাঁদের ধরে ফেলে পিটুনি দেয় ও গুলি করে গুরুতর জখম করে, যার কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়।
তবে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খান বলেন, শেওড়াপাড়া এলাকা (কাফরুল থানার মধ্যে পড়েছে) থেকে ওই তিনজনকে তিনটি ককটেল, চার লিটার পেট্রলসহ ধরে জনতা। এরপর তাঁদের মিরপুর থানাধীন বাইশবাড়ী এলাকায় নেওয়া হয়। সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁদের পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। কারা গুলি করল জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকের কাছেই লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। মানুষকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছে নিজের ও অন্যের জানমাল রক্ষার জন্য। এখন সেই অস্ত্র নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আসলে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জনরোষের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ।
ওসি জানান, পুলিশ গতকাল পর্যন্ত গুলিবর্ষণকারীকে শনাক্ত করতে পারেনি। নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় জানা গিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা পেশাদার নাশকতা সৃষ্টিকারী। যারা প্রথমে তাদের ধরেছে, তারা বলেছে, ওই নাশকতাকারীরা মনিপুর স্কুলের একটি শাখা পুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের নাম-পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আসছে। এগুলোর কোনোটিরই সত্যতা সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলেনি।
পুলিশ জানিয়েছে, এই তিনজনের নাম জুয়েল, সুমন ও রবিন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাইশবাড়ী গলিতে জনতার ধোলাই ও গুলিতে তিন বোমাবাজ নিহত হয়েছে। এ ব্যাপারে মিরপুর মডেল থানায় মামলা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গুলির খোসা-রক্তাক্ত দড়ি: কাজীপাড়ার বাইশবাড়ীতে সড়কে পয়োনিষ্কাশনের পাইপ বসাতে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এ কারণে যানবাহন চলে না। যেখান থেকে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু, তার পাশেই একটি গলি। সেই গলিতে গতকাল সকালে গিয়ে দেখা গেল, আবর্জনার মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো কিছু গুলির খোসা। পাশে রক্তমাখা এক ছড়ি নাইলনের দড়ি, জমাট কালচে রক্ত। এলাকাবাসী জানান, আরও কিছু গুলির খোসা ছোট ছেলেমেয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে।
সাধারণত গণপিটুনির ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে এর শিকারদের কাপড়-চোপড়, স্যান্ডেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। পড়ে থাকে লাঠি বা গণপিটুনিতে ব্যবহৃত উপকরণও। তবে এই ঘটনাস্থলে গুলির খোসা, দড়ি ছাড়া সে রকম কিছু ছিল না।
ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন, রোববার রাতে এখানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি। রাত পৌনে ১০টার দিকে অপরিচিত ১০-১২ জন লোক ওই তিন তরুণকে বেঁধে অন্ধকার গলিতে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর গলি থেকে একসঙ্গে প্রচুর গুলির শব্দ আসে। প্রায় এক ঘণ্টা পর লোকগুলো তিন তরুণের লাশ ফেলে চলে যায়। পরে গভীর রাতে পোশাকধারী পুলিশ এসে গাড়িতে করে লাশগুলো নিয়ে যায়।
গলির দুই পাশে দুটি বাড়ি। দুটি বাড়ির ফটকে গতকাল বাসিন্দা ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাতের গুলির ঘটনার পর থেকে বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী বলেন, হঠাৎ গুলির শব্দে তিনি ভয়ে ফটকে তালা দিয়ে অভ্যর্থনা কাউন্টারের পেছনে লুকান। ঘটনার আগে-পরে তিনি কোনো চিৎকার, হইচই শোনেননি।
এলাকার আরও কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গণপিটুনি হলে তাঁরা লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতেন। কিন্তু শুনেছেন কেবল গুলির শব্দ।
রাত দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে লাশগুলো নিয়ে যান এসআই মাসুদ পারভেজ। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের রোগীনিবন্ধন ও মৃত্যুনিবন্ধন খাতায় এই তিনজনকে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাঁদের মৃত্যুর কোনো কারণ না লিখেই মৃত ঘোষণা করেছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। তবে মৃত্যুনিবন্ধন খাতায় আর সব মৃত্যুর কারণ উল্লেখ রয়েছে।
ওদুদকে হত্যার অভিযোগ পরিবারের: ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আবদুল ওদুদ ঝুট ব্যবসায়ী বলে তাঁর পরিবার দাবি করেছে। গতকাল বিকেলে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে লাশ শনাক্ত করার পর তাঁর বাবা আবদুল আলী ব্যাপারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ ওদুদকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। রোববার সকালে মোটরসাইকেলে করে টোলারবাগের বাসা থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের সি ব্লকের দোকানে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন ওদুদ। মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। কোথাও খুঁজে না পেয়ে বেলা তিনটার দিকে তিনি মিরপুর থানায় যান। গিয়ে দেখেন, ওদুদের হিরো সিবিজেড মোটরসাইকেল থানার প্রাঙ্গণে। তিনি ওদুদের খোঁজ করলে জানানো হয়, এই নামে কাউকে আটক করা হয়নি। ভোরে টিভির খবরে ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তো রাজনীতি করে না। আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। ওর নামে তো কোথাও জিডিও নাই। তার পরও আমার ছেলেরে ধইরা মাইরা ফেলল। কেন মারল, এটা আমি আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে জানতে চাই।’
তবে পুলিশ বলছে, ওদুদ ১০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের আহ্বায়ক ছিলেন। মিরপুর থানার ওসি সালাহউদ্দীন খানের দাবি, রোববার সকাল ১০টার দিকে ওদুদকে আটক করা হয়। এরপর তাঁকে নিয়ে সহযোগীদের ধরতে দিনভর অভিযান চালানো হয়। রাত দেড়টার দিকে টেকনিক্যাল মোড়সংলগ্ন হাউজিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সামনের পদচারী সেতুর নিচে তাঁকে নিয়ে অভিযানে যায় পুলিশ। এ সময় তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি-ককটেল ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে সহযোগী সন্ত্রাসীদের গুলিতেই ওদুদ নিহত হন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে।
ওদুদের চাচা চান মিয়া ব্যাপারী জানান, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ওদুদ ছোট। তাঁরা পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী। ওদুদ কখনো রাজনীতি করেননি। বিএনপি করলে তো তিনি আর এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে থাকতেন না।
ঝিনাইদহে দুই যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ: নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝিনাইদহ জানান, গতকাল সকালে সদর উপজেলার ডেফলবাড়িয়া গ্রামের একটি মাঠ থেকে উপজেলার চরখাজুরা গ্রামের নাসিম বিশ্বাসের ছেলে দুলাল হোসেন (২৬) ও সদর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার বিএনপির নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম আজম ওরফে পলাশের (২৮) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, নিহত দুজনই বিএনপির কর্মী ছিলেন।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, চার-পাঁচ দিন আগে এই দুজনকে পৃথক স্থান থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। গতকাল ভোরে তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
তবে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি শাহাবুদ্দিন আজাদ বলেন, খবর পেয়ে তাঁরা দুজনের লাশ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছেন। কারা, কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তাঁরা। পরিবারের অভিযোগ ঠিক নয়। পুলিশের ধারণা, ভোররাতের দিকে তাঁদের হত্যা করে লাশ মাঠে ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা।
জহির রায়হান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ভোর ছয়টার দিকে হাঁটতে বের হয়ে তিনিসহ পথচারীরা লাশ দুটি পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেন। সদর থানার পুলিশ সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে। এর মধ্যে শত শত জনতা লাশ দেখতে ভিড় করে। চরখাজুরা গ্রামের বেশ কয়েকজন এসে নিহত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করেন। তাঁরা জানান, বেশ কয়েক দিন ধরে তাঁরা নিখোঁজ ছিলেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, পলাশ কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। তাঁর স্ত্রী ও আড়াই বছরের এক মেয়ে রয়েছে। পলাশের স্ত্রী নাজনীন নাহার অভিযোগ করেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি পলাশকে খুঁজতে বাড়িতে পুলিশ আসে। পলাশ বাড়িতে ছিলেন না। পুলিশ ঘরে তল্লাশি চালায়। পরদিন পলাশ দশমাইল বাজারে গেলে সেখান থেকে তাঁকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় বলে জানতে পারেন। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও তাঁর দেখা মেলেনি। তিনি বলেন, ‘পলাশের নামে কোনো মামলা ছিল না। তার পরও পুলিশ তাঁকে ধরতে আসে। তাঁকে মেরে ফেলতেই খোঁজাখুঁজি করেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত সেটাই করল।’
নিহত দুলালের ভাই আলাল হোসেন বলেন, তাঁরা যমজ ভাই। দুলাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি দুলাল মালামাল কিনতে ঝিনাইদহ শহরে যান। এরপর তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। তাঁর মুঠোফোনও ছিল বন্ধ। তাঁরা অনেক খুঁজেছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরেও গেছেন। কিন্তু সন্ধান পাননি। গতকাল লাশ পাওয়া গেল।