কারও কাছে নেই সালাহ উদ্দিন

সালাহ উদ্দিন আহমদে
সালাহ উদ্দিন আহমদে

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের খোঁজ জানে না পুলিশ। পুলিশের পাঁচটি শাখা বলেছে, তারা সালাহ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার বা আটক করেনি। তবে তাঁকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
হাইকোর্টকে দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বিশেষ শাখা (এসবি) পাঁচটি আলাদা প্রতিবেদনে এ দাবি করেছে। গতকাল রোববার সকালে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। বেলা আড়াইটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তা আদালতে দাখিল করেন।
সালাহ উদ্দিন আহমদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে গত বৃহস্পতিবার তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমদ হাইকোর্টে আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল দেন। এতে আদালত জানতে চান, সালাহ উদ্দিনকে কেন খুঁজে বের করে ১৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হবে না। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। আদালতের ওই আদেশ মেনে পুলিশ গতকাল প্রতিবেদন দেয়।
পুলিশের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ১১ মার্চ রাত পৌনে ১১টার দিকে হাসিনা আহমদ ২০-২৫ জন টিভি সাংবাদিক ও ক্যামেরা নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় যান। তিনি পুলিশকে জানান, ১০ মার্চ রাত নয়টা থেকে ১০টার মধ্যে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছেন। কার কাছে সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেলেন? পুলিশের এ প্রশ্নের জবাবে হাসিনা আহমদ সদুত্তর দিতে পারেননি। পুলিশ প্রশ্ন তুলেছে, কেন সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য পুলিশকে জানাতে ২৪ ঘণ্টার বেশি দেরি হলো এবং কেন সাংবাদিকদের থানায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল?
পুলিশ প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে মাহবুবে আলম আরও বলেন, উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের তিনতলা ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকে থাকতেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ডিএমডি হাবিব হাসনাত ও তাঁর স্ত্রী সুমনা। পুলিশ যখন সেখানে যায়, তখন ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে দারোয়ান আখতার জানান, চার দিন আগে হাসনাত-সুমনা দম্পতি বাইরে যান। এ সময় ‘রায়হান’ নামে একজন মেহমানকে রেখে যান। হাসনাত দারোয়ানদের বলে যান, তাঁদের অনুপস্থিতিতে এই মেহমান বাসায় থাকবেন। ওই বাড়িতে রাত ১১টা পর্যন্ত ভাড়াটেরা গাড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া করতেন। ১০ মার্চ আনুমানিক নয়টার দিকে চার-পাঁচজন হাসনাতের বাসায় যান। আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর মেহমান ওই চার-পাঁচজনের সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে যান। ওই লোকটি সালাহ উদ্দিন কি না, সেটা তাঁরা জানেন না। বাসায় যাওয়া লোকদের গায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক ছিল না। তাঁদের কাছে কোনো অস্ত্রও দেখা যায়নি। বাইরে যে গাড়িটি অপেক্ষা করছিল, সেটাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির মতো মনে হয়নি। মেহমানের হাতে কোনো হাতকড়া ছিল না, তাঁকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও মনে হয়নি।
তবে গত বৃহস্পতিবার আখতারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মঙ্গলবার রাত সোয়া নয়টার দিকে বেশ কয়েকটি গাড়ি নিয়ে একদল লোক ওই বাসার সামনে আসেন। বাসার সামনে তিনটি গাড়ি ছিল। কিছুক্ষণ পর রাত ১০টা নাগাদ তাঁরা এসে বলেন, ‘আমরা ডিবির লোক। কোনো সমস্যা নেই।’ পকেট গেট খোলা ছিল। তাঁরা কয়েকজন সেই গেট দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লে আখতারুল জিজ্ঞেস করেন, ‘কী কারণে আসছেন?’ তাঁরা বলেন, ‘পরে জানতে পারবি।’
ওই সময় আখতারুল আরও বলেন, এ সময় দুজন তাঁকে ‘চটকনা’ দেন। তাঁদের কাছে পিস্তল দেখে ভয় পান আখতারুল। তাঁরা নিজেদের ডিবির লোক বলে পরিচয় দেন এবং আখতারুলকে ‘চুপ করে বইসা থাক’ বলে কয়েকজন দোতলায় চলে যান। লোকগুলো এরপর ২০-২৫ মিনিট ছিলেন। নামার সময় চোখ বাঁধা অবস্থায় দুজন দুই পাশে ধরে তাঁকে (সালাহ উদ্দিন) নিয়ে নেমে যান। পরে একটি মাইক্রোবাসে তুলে সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে চলে যান অস্ত্রধারীরা।
আশপাশের আরও তিনটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরাও মনে করেন, ১০ মার্চ রাতে গাড়িতে করে আসা অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য।
গতকালের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, সালাহ উদ্দিনকে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশের সবগুলো সংস্থা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তারা সেটা চালিয়ে যাবে। এ অবস্থায় আদালতের আর কিছু করণীয় নেই। রুলটি নিষ্পত্তি করা হোক।
এর বিরোধিতা করে আবেদনকারীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, পুলিশের এই প্রতিবেদনের অনুলিপি তাঁরা পাননি। এই প্রতিবেদনের কয়েকটি বক্তব্য খুবই অস্পষ্ট, এসব বিষয়ে তিনি জবাব দিতে চান। এ ছাড়া পুলিশের যে প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আদালতে দিয়েছে, তাতে হলফনামা যুক্ত করা হয়নি।
আদালত বলেন, ‘এ ধরনের একটা বিষয়ে আমরা এত সময় কেন নেব? আমরা রুল নিষ্পত্তি করে দিতে পারি এই পর্যবেক্ষণ রেখে যে তাঁকে খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া যেন অব্যাহত থাকে। আমাদের সামনে আরও অনেক মামলা আছে।’
মওদুদ আহমদ বলেন, এটা সাধারণ কোনো মামলা নয়, এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর শুনানি করা আবেদনকারীর অধিকার। এটা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।
আদালত আজ সোমবার দুপুর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। এ সময় আদালত পুলিশ প্রতিবেদনের সঙ্গে হলফনামা যুক্ত করার এবং আবেদনকারীকে একটি অনুলিপি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
২৪ ঘণ্টা পর কেন: সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর কেন পুলিশকে জানালেন? এ প্রশ্নের জবাবে হাসিনা আহমদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে যে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। ১০ মার্চ রাত ১০টার দিকে সালাহ উদ্দিন আমাকে ফোন করে এটা বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় বুঝতে পারিনি। এ ছাড়া সালাহ উদ্দিনকে আশ্রয় দেওয়ায় হাবিব হাসনাতের মধ্যেও গ্রেপ্তার আতঙ্ক তৈরি হয় বা তাঁকে ভয় দেখানো হয়। তাই তিনি দুবাই চলে যান। তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এ জন্য পুলিশের কাছে যেতে পারিনি। ১১ মার্চ দুপুরে হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। এরপর দলের সঙ্গে কথা বলি। নজরুল ইসলাম খান বিবৃতি দেন। উনি থানায় জিডি করতে বলেন।’
সাংবাদিকদের নিয়ে থানায় যাওয়া প্রসঙ্গে হাসিনা বলেন, ‘আমি কোনো সাংবাদিক নিয়ে যাইনি। নজরুল ইসলাম খানের বিবৃতি থেকে সাংবাদিকেরা জেনেছেন, তাঁরা নিজেরাই থানায় গেছেন।’
পুলিশি তৎপরতা নেই: সালাহ উদ্দিন আহমদকে খুঁজতে পুলিশের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, যেভাবে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ২১ ঘণ্টা পর র্যাব গ্রেপ্তার দেখিয়ে গুলশান থানায় সোপর্দ করেছে, সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রেও তাঁরা সে রকম ধারণা করছেন। সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা সংস্থা কখন তাঁকে ফেরত দিয়ে যাবে, সেই অপেক্ষায় কর্মকর্তারা বসে আছেন।
গত কয়েক দিনে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে ধারণা করা যায়, সালাহ উদ্দিন আহমদ অপহরণের বিষয়টি অজানা নয়। এ নিয়ে উচ্চমহল খুব একটা উদ্বিগ্নও নয়। কারও কারও ধারণা, দু-এক দিনের মধ্যেই এই রহস্য উদ্ঘাটিত হতে পারে।
জানতে চাইলে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ইলিয়াসের মতো হয়ে যাচ্ছে। ইলিয়াসের কোনো সমাধান হয়নি। এও মনে হচ্ছে একটা রহস্য। প্রধানমন্ত্রী বললেন, “মালপত্রের সঙ্গে ওনাকে বের করে দিয়েছে।” তাহলে প্রধানমন্ত্রী জানেন, সালাহ উদ্দিন কোথায় গিয়েছেন। তাহলে তাঁকে বের করে দিন। যেকোনো দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটা মানে আপনি-আমি সবাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাই। আশা করি, এটার সুরাহা হবে। কালকে কোর্টে কী হয় দেখি।’
‘নিখোঁজ’ সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার বলেছিলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আমরা তাঁকে অ্যারেস্ট করার জন্য খুঁজছি। তিনি কোথায়, তার জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারবেন। সালাহ উদ্দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে বিবৃতি দিচ্ছিলেন। কিন্তু সবাই জানে, তিনি ওখান থেকেই (খালেদা জিয়ার কার্যালয়) বিবৃতি দিয়েছেন। আট বস্তা ময়লার সঙ্গে তাঁকেও কোথাও পাচার করে দিয়েছেন কি না, সে জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারবেন।’