শেষ হচ্ছে ৪১ বছরের অপেক্ষা

বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করছেন বড় গাঁওচুলকা ছিটমহলের বাসিন্দারা। ভারতের রাজ্যসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল পাস হওয়ায় খুশি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ভারতীয় এই ছিটমহলের মানুষ l ছবি: সফি খান
বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করছেন বড় গাঁওচুলকা ছিটমহলের বাসিন্দারা। ভারতের রাজ্যসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল পাস হওয়ায় খুশি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ভারতীয় এই ছিটমহলের মানুষ l ছবি: সফি খান

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সীমান্ত বিল গতকাল বুধবার সর্বসম্মতভাবে পাস হলো রাজ্যসভায়। দুপুরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ করেন। তিনি বলেন, একাত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে উচ্চতায় উঠেছিল, এই বিল পাস হলে সম্পর্ক আবার সেই উচ্চতায় পৌঁছাবে। রচিত হবে সহযোগিতা ও বন্ধুতার এক নতুন সংজ্ঞা।
আড়াই ঘণ্টা বিতর্কের পর সংবিধান সংশোধন বিলটি নিয়ে ভোটাভুটি হয়। সভায় উপস্থিত ১৮১ সদস্যের সবাই বিলের পক্ষে ভোট দেন। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়েন বলেন, এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি। কখনো কখনো এমনই হওয়া দরকার। সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাঁকে উদ্দেশ করে সুষমা বলেন, ‘এই বিল মনমোহনজিরই। তাঁর কাজ আমরা সমাপ্ত করলাম। এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, ৪১ বছর পর একটা চুক্তি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।’
বিল পেশের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংক্ষিপ্তভাবে এই বিলের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, নানা সময়ে নানা কারণে নানান উদাসীনতার দরুন এই বিল বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। এই বিল ২০১৩ সালে যখন রাজ্যসভায় পেশ হয়েছিল, তখন বিজেপি, আসাম গণ পরিষদ (অগপ) ও তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করেছিল।
বিজেপি ও অগপ মনে করেছিল, এই বিল পাস হলে আসামের ক্ষতি হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেছিলেন, বিল পাস হলে ছিটমহলের মানুষ বিনিময়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। শেষ পর্যন্ত সব পক্ষই এই বিল প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন।
সুষমা স্বরাজ রাজ্যসভার সদস্যদের জানান, এই চুক্তি বাস্তবায়নে ৩ হাজার ৯ কোটি রুপির মতো খরচ হবে। তার মধ্যে অবকাঠামো তৈরিতে খরচ হবে ৭৭৫ কোটি, বাকি ২ হাজার ২৩৪ কোটি রুপি ছিটমহলের অধিবাসীদের, যারা ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারতে আসতে চাইবে, তাদের পুনর্বাসনে খরচ হবে। বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহলগুলোতে যে ৩৫ হাজার লোক বাস করেন, তাঁদের সবার জন্য ওই ২ হাজার ২৩৪ কোটি রুপি ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু জনগণনার সময় দেখা গেছে, ভারতে আসতে আগ্রহী ছিটমহলের সাড়ে তিন হাজার লোক।
গতকাল রাজ্যসভায় সব রাজনৈতিক দলের ২১ জন এই বিল নিয়ে তাঁদের মত দেন। সবাই বিলটি সমর্থন করেন। তবে তামিলনাড়ুর ডিএমকে, এডিএমকে এবং ওই রাজ্য থেকে নির্বাচিত সিপিআই সদস্য ডি রাজা শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেওয়া কাচ্চিতিভু দ্বীপ ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান।
সুষমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ ব্যাপারে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। একই আশ্বাস দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ২০১৩ সালের বিলে তাঁরা আপত্তি জানিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করায়। সেই আপত্তির ফলেই আজ পুনর্বাসন প্যাকেজ সম্পূর্ণ হতে পেরেছে। সিপিএমের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যসহ অনেকেই বিলের ওপর বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এক অবাঙালি নির্দল সদস্য পরিষ্কার বাংলায় ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি... বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ গানটি গাইতে শুরু করেন। গাইতে গাইতে তিনি কেঁদে ফেলেন।
জনতা দলের (সংযুক্ত) নেতা শরদ যাদব বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য কর্ণ সিং বলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার একমাত্র সদস্য হিসেবে আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী।’ বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তাই দেরিতে হলেও এই চুক্তিকে স্বাগত।
বিরোধী নেতা গুলাম নবী আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ এই উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। কুরসি বদলের সঙ্গে মন বদল ঘটেছে বলে আমি খুশি।’
সীমান্ত বিলটি আজ বৃহস্পতিবার লোকসভায় আনা হচ্ছে।