দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাস্করের লন্ডন জয়

লন্ডন বুক ফেয়ারে পুরস্কার হাতে ভাস্কর ভট্টাচার্য।
লন্ডন বুক ফেয়ারে পুরস্কার হাতে ভাস্কর ভট্টাচার্য।

ছোটবেলায় নতুন বই হাতে পাওয়ার যে আনন্দময় অনুভূতি, তা অনুভব করতে পারেননি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাস্কর ভট্টাচার্য। পুরোনো বই মা-বাবা পড়ে শোনাতেন, তিনি শুনতেন। কখনো কখনো স্কুলের সামাদ স্যার কষ্ট করে ম্যানুয়ালি ব্রেইল করে দিতেন। এতদিন পর ২০১৫ সালে এসেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের হাতে নতুন বই থাকবে না, তা মানতে পারেননি তিনি। তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, পাঠ্যপুস্তক বা প্রকাশনীতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা বাড়ানোর কাজে লেগে গেলেন; ডিজিটাল বই প্রকাশ করে স্বীকৃতি পেলেন যুক্তরাজ্য থেকে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ভাস্করের সংগঠন ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) লন্ডন বুক ফেয়ার থেকে পেয়েছে ‘একসেসিবল পাবলিশিং ইনিশিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’। গত ১৪ এপ্রিল তিনি ও ইপসার প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।

তবে পুরস্কার পাওয়ার পথটি সহজ ছিল না। বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও ফ্রান্স। তবে চূড়ান্ত পুরস্কারটি জমা হয় বাংলাদেশের ঘরে। ভাস্করের সংগঠন ইপসার পুরস্কার প্রাপ্তিতে সহযোগিতা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েব একসেসিবিলিটি উইথ অ্যাক্টিভিটিজ অব অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের। প্রকল্পটির সহযোগিতায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ সব শিক্ষার্থীর উপযোগী ডেইজী মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল বই প্রকাশের জন্যই মিলেছে এ পুরস্কার। এ ধরনের বই পড়তে, শুনতে ও দেখতে পাওয়া যায়। বইগুলোর ডিজিটাল ব্রেইল কপিও আছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ইউনিকোড-ভিত্তিক ইলেকট্রনিক বইগুলো এ বছরই প্রথম শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বইগুলোর ইউনিকোড ভার্সন জাতীয় ই-তথ্যকোষের ওয়েবসাইটেও আছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ডেইজী মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল বই তুলে দেন। আগামী বছর থেকে মাধ্যমিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে এ ধরনের বই তুলে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন ভাস্কর।

ভাস্কর ভট্টাচার্য পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের তরুণদের জন্য জাপান সরকারের ডাস্কিন লিডারশিপ ট্রেনিংয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। সেখানে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং ডেইজী আইসিটি অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার অন ডিজঅ্যাবিলিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এটুআই প্রকল্পেরও একজন বিশেষজ্ঞ, কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।

পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে ভাস্কর বলেন, ‘সে এক অসাধারণ অনুভূতি। বাংলাদেশ পুরস্কার পেয়েছে। সেই পুরস্কার আনতে আমি গিয়েছি। কেমন যে লেগেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে ভাস্কর ভট্টাচার্য।
স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে ভাস্কর ভট্টাচার্য।

ভাস্কর মনে করেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হুইল চেয়ার বা সাদাছড়ি দিয়ে চ্যারিটির মনোভাব দেখিয়ে সরকারের দায়িত্ব শেষ নয়। তাদের হাতে ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোনসহ প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন জিনিস দিতে হবে। জিনিসগুলো যাতে কাজে লাগে, সেই উদ্যোগও নিতে হবে।

ব্যক্তিজীবনে ভাস্কর দুই মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী শ্যামশ্রী দাশ ইপসাতে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। প্রথম দেখায় ভাস্কর কথা না বলায় শ্যামশ্রী তাঁকে মুডি ভেবেছিলেন। তবে পরে যখন জানতে পারেন, ভাস্কর চোখে দেখেন না তখন ভীষণ অনুশোচনা হয়। তারপর এক সঙ্গে কাজ করতে করতে ভালো লাগা। তবে বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছে। বেশ মজা করে ভাস্কর বললেন, ‘আমি তাঁকে বলেছিলাম, সারাজীবন তোমার হাত ধরে চলতে পারব। আশপাশের কেউ কিছুই মনে করবে না।’

একটি জাতীয় অনলাইন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভাস্করের। তবে কপিরাইট আইনের কারণে চাইলেই যেকোনো বই নিয়ে কাজ করা সম্ভব না বলে জানেন তিনি। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি তাঁর সব বই নিয়ে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩টি বইকে প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে টকিং বুক করেছেন তিনি। কাজ করে যাচ্ছেন কপিরাইট আইন সংক্রান্ত মারাকাস চুক্তিতে বাংলাদেশ যাতে সই করে, তার জন্যও।