সাড়ে ১৪ লাখ নিবন্ধন বৃথা যেতে বসেছে

মালয়েশিয়ায় সরকারি পর্যায়ে কর্মী পাঠানোর জন্য সাড়ে ১৪ লাখ শ্রমিকের নিবন্ধন শেষ পর্যন্ত বৃথা যেতে বসেছে। বনায়ন খাতে করা এই তালিকা থেকে প্রথম দফায় ১০ হাজার কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও গত আট মাসে গেছেন মাত্র ৪৫৫ জন।

বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এই তালিকা থেকে লোক নিতে বলা হলেও তারা রাজি হয়নি। ওই নিবন্ধন কার্যক্রমে খরচ হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা।

এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশে কর্মী পাঠানোর জন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে সরকার আবারও সারা দেশে নিবন্ধন শুরু করেছে। চলবে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত। আগের নিবন্ধনের জন্য স্থাপনা ও নানা সরঞ্জামও এবার ব্যবহূত হবে। আগে যাঁরা নিবন্ধন করেছিলেন, তাঁদেরও এবার নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে।

কিন্তু এবার যাঁরা নিবন্ধন করছেন, তাঁদের কোথায়, কীভাবে পাঠানো হবে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি সরকার। আর বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারের তালিকা থেকে কর্মী নিতে না চাওয়ায় এই নিবন্ধন কতটা সফল হবে, তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে সরকার বলছে, ভবিষ্যতে কর্মী পাঠাতে হলে সবাইকে এই তালিকা থেকেই পাঠাতে হবে।

দীর্ঘ কূটনৈতিক যোগাযোগের পর গত বছরের নভেম্বরে শ্রমিক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মালয়েশিয়া। সরকারিভাবে কর্মী নিয়োগে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সে সময় প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মালয়েশিয়া প্রথম দফায় বনায়ন খাতে ১০ হাজার এবং পরে ২০ হাজার কর্মী নেবে। বছরে অন্তত এক লাখ করে পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ কর্মী পাঠানোর আশা প্রকাশও করেছিলেন তিনি।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৬ জনের নিবন্ধন করা হয়। নিবন্ধিত কর্মীদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে ১১ হাজার ৭৫৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়, যার মধ্যে মালয়েশিয়া গেছেন মাত্র ৪৫৫ জন। গত ১৭ জুলাই লটারির মাধ্যমে আরও ১১ হাজার ৭০৪ জনকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এই ২৩ হাজারের বেশি কর্মী কবে নাগাদ মালয়েশিয়া যাবেন, সে বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই।

মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তালিকা থেকে আর বড়জোর কয়েক হাজার কর্মী যেতে পারবেন। ফলে আগের তালিকাটি আর কোনো কাজে আসবে না।

জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়াটি নতুন। তাই দুই দেশের জন্যই সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা আশা করছি, শিগগিরই মালয়েশিয়ায় আরও লোক যাবে।’

মালয়েশিয়ার জন্য নিবন্ধন করা সাড়ে ১৪ লাখ কর্মীর কী হবে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা সব দেশের জন্য নিবন্ধন করছি। মালয়েশিয়ার জন্য যাঁরা নিবন্ধন করেছিলেন, তাঁরা অন্য কোথাও যেতে চাইলে এখন নিবন্ধন করতে হবে।’

এবার যাঁরা নিবন্ধন করবেন, তাঁরা কোন দেশে যাবেন, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের চাহিদাপত্র আসছে। যখন যে দেশে লোক লাগবে, সেই দেশে আমরা পাঠাব।’

বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারি তালিকা থেকে লোক নেবে কি না, প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রতারণা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেই এ উদ্যোগ। সরকারি তালিকা থেকে লোক নিলে অভিবাসন খরচ অনেক কমে আসবে। আমরা আইন করেছি। সরকারি নিবন্ধনের বাইরে লোক নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।’

বেসরকারি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সারা দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে লাখ লাখ লোকের নিবন্ধন করালেও সরকার মালয়েশিয়ায় সেভাবে লোক পাঠাতে পারেনি। এমন অবস্থায় এ বছরের ২৮ মার্চ সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, এখন থেকে সরকারি তথ্যভান্ডার থেকেই বিদেশে লোক পাঠাতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, এই নির্দেশের পর তাঁরা বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র জমা দিলেও সেগুলোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা সরকারি ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সরকারি প্রজ্ঞাপন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। সরকারের পক্ষ থেকে চেম্বার জজের কাছে আবেদন করা হয়। আদালত আগের আদেশ বহাল রাখেন।

বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমরা আমাদের তথ্যভান্ডার থেকে কর্মী পাঠাতাম। কিন্তু মালয়েশিয়ার জন্য নিবন্ধন করা তালিকা থেকে আমাদের কর্মী পাঠাতে বাধ্য করার চেষ্টা করে সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রিট করি।’

সরকারি তথ্যভান্ডার থেকে কর্মী পাঠালে সমস্যা কী, জানতে চাইলে আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘সরকার মালয়েশিয়ায় নিবন্ধন করেছিল শুধু বনায়ন খাতের শ্রমিকদের জন্য। সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল। এখন সেই লোক দিয়ে তো আমাদের কাজ চলবে না; বরং যে দেশ যেমনভাবে লোক চায়, আমাদের তেমন দক্ষতা অনুযায়ী লোক পাঠাতে হয়।’ এখন যে তালিকা হচ্ছে, সেখান থেকে কর্মী নেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।