পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এখনো অকার্যকর

প্রায় দুই বছর পর সরকার গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পুনর্গঠন করেছে। কিন্তু এ কমিশন নয় মাসেও কার্যকর হতে পারেনি। ফলে আগের কমিশনগুলোর মতো এটির কার্যকারিতা নিয়েও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর না হওয়ার প্রধান কারণ ২০০১ সালের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন না হওয়া। আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। পরে জেএসএস চুক্তির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ আইনটির ২৯টি সংশোধনী দাবি করে। একাধিক সরকারের মেয়াদে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। প্রায় দুই বছর আগে ১৩টি সংশোধনীর বিষয়ে সরকার ও জেএসএস একমত হয়। কিন্তু এখনো আইনটি সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবে ভূমি মন্ত্রণালয়। সেখানেই আইনের খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আইনের সংশোধনীর খসড়ায় বারবার পরিবর্তনের কারণে এত দিন পার হয়েছে। সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনে এটি উত্থাপিত হতে পারে।
অবশ্য কয়েক বছর ধরেই সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে আইনটি সংশোধনের জন্য উত্থাপিত হওয়ার কথা শোনা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হককে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে সরকার বর্তমান কমিশন পুনর্গঠন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে প্রণীত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ অনুযায়ী তিন বছরের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
কমিশনের সূত্র জানায়, নতুন নিযুক্ত চেয়ারম্যান গত ১৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে বসেন। ওই দিনই তিনি কমিশনের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের কথা জানান। সদস্যদের সহযোগিতা ও কমিশনের সভা অনুষ্ঠানের বিষয়েও তিনি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এঁদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান কমিশনের অন্যতম সদস্য। সে হিসেবে চেয়ারম্যান তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। সন্তু লারমা তখন চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সভা করে কোনো লাভ হবে না। ত্রুটিপূর্ণ আইনের ভিত্তিতে কমিশনের কোনো কাজ তাঁরা মানবেন না।
এর আগে বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে পুনর্গঠিত কমিশনও একই কারণে কার্যকর হতে পারেনি। বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী তখন বলেছিলেন, আইন সংশোধন সরকারের বিষয়। সে জন্য কমিশন অকার্যকর থাকতে পারে না। বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই কমিশন কাজ করবে। সে অনুযায়ী তিনি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে যাঁদের ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে তা নিষ্পত্তির জন্য আবেদন আহ্বান করেন। তখন প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদন জমা পড়ে ছিল। কিন্তু ওই কমিশন একটি আবেদনেরও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। ভূমি জরিপের উদ্যোগও সফল হয়নি।
ওই কমিশনের মেয়াদ ২০১২ সালের ১৮ জুলাই শেষ হয়। এরপর থেকে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমিশন ছিল না। এরও আগে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে আরও তিনটি কমিশন গঠন ও পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু কোনোটি কার্যকর হয়নি।
১৯৯৯ সালের ৩ জুন গঠিত প্রথম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী কার্যভার গ্রহণের আগেই মারা যান। ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল পুনর্গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুল করিম কার্যভার গ্রহণের কিছুদিন পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেন।
২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর পুনর্গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মাহমুদুর রহমান ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জেএসএসের বিরোধিতার কারণে কাজ শুরু করতে পারেননি। জেএসএসের বিরোধিতার কারণ ছিল আইন সংশোধন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিশনে চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য চার সদস্য হলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট সার্কেল প্রধান (যখন যে এলাকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাজ চলবে, তখন সেই এলাকার সার্কেল প্রধান সদস্য থাকবেন), চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।