'আর নয় ছিটবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশি'

৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান হয়েছে। তাই ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই মুক্তির আনন্দ উদ্‌যাপনের প্রতীকী আয়োজন শুরু হয় গতকাল সন্ধ্যা থেকেই। পঞ্চগড় সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহল থেকে রাত সাড়ে নয়টায় তোলা ছবি l প্রথম আলো
৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান হয়েছে। তাই ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই মুক্তির আনন্দ উদ্‌যাপনের প্রতীকী আয়োজন শুরু হয় গতকাল সন্ধ্যা থেকেই। পঞ্চগড় সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহল থেকে রাত সাড়ে নয়টায় তোলা ছবি l প্রথম আলো

রাত তখন ১২টা ১ মিনিট। পূর্ণচাঁদের রাত। চাঁদের আলোয় আলোকিত পঞ্চগড়ের গারাতী ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে উপস্থিত হাজারো কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো ‘আর নয় ছিটবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশি। মুজিব-ইন্দিরার চুক্তি, ছিটবাসীর মুক্তি।’
ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী রাত ১২টা ১ মিনিটে এখানকার ১২টি ছিটমহল বাংলাদেশের হয়ে গেল। তাতেই মধ্যরাতে মশাল হাতে ছিটমহলবাসী মুক্তির আনন্দে মেতে উঠলেন। এখন থেকে পঞ্চগড়ে কোনো ছিটমহলের অস্তিত্ব নেই। ১২টি ছিটমহলের ৬ হাজার ১৯০ দশমিক ৭৮ একর জমি এখন বাংলাদেশের। মুক্তি ঘটল ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের।
মুক্তি ও মানচিত্র বদলের আনন্দে ভেসেছে জেলার ১২টি ছিটমহলের ২০ হাজার মানুষ। মশাল, মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়ে এবং পতাকা উড়িয়ে তাঁরা নতুন দেশকে বরণ করেছেন।
প্রতিটি মানুষের মুখে একই কথা, আমরা বাংলাদেশি হয়ে গেছি। ‘শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদি, মানবতার কবি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ এমনই স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়েছে গারাতী ছিটমহলের মাঠ।
মুক্তির সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন ছিটমহলে চলে উৎসব। নেচে-গেয়ে তাঁরা নতুন দেশকে বরণ করে নিতে চান।
নিয়ম অনুযায়ী রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহল বাংলাদেশের অংশ হওয়ার কথা। প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, রাত ১২টার আগে কোনো ছিটমহলে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো যাবে না। জেলার পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, আজ সকাল ছয়টায় রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁরা প্রতিটি ছিটে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াবেন।

কিন্তু আনন্দের বানে ভাসতে থাকা মানুষ তাঁদের আবেগ আর উচ্ছ্বাসকে সামলে রাখতে পারেননি। পঞ্চগড় সদর উপজেলার গারাতী ছিটমহলে দেখা গেছে, সকাল থেকেই বিভিন্ন বাড়ি ও উৎসবের মাঠে পতপত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।
সকাল আটটা থেকে ৭৮ নম্বর গারাতী ছিটমহল ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে মেলা বসে। নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরা মাথায় বাংলাদেশের পতাকার রঙের ব্যাজ ধারণ করে মেলায় আসেন। মেলার মাঠে তাঁরা নেচে-গেয়ে পটকা ফাটিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন। সন্ধ্যার পর মঞ্চস্থ হয় নাটক চুক্তির মুক্তি। নাটকটি রচনা করেছেন আবদুর রহিম। নাটকটি মঞ্চস্থ করে বিদ্রোহী শিশু-কিশোর থিয়েটার। অভিনয় করেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। এ সময় জেলা পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লায়লা মুন্তাজেরী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সন্ধ্যার পর পালাগান ও কবিগানের আসর বসে। পরিবেশন করেন নাসিমা খাতুন ও বাউল শাহজাহান। তারই আগে উৎসাহী এলাকাবাসী একদফা মশাল মিছিল করেন। একই সময়ে অনেক মুসলিম বাড়িতে জ্বলে ওঠে ৬৮টি করে মোমবাতি এবং হিন্দু বাড়িতে জ্বলে ওঠে ৬৮টি প্রদীপ। ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসানের উপলক্ষে এই প্রজ্বালন।
স্থানীয় চেয়ারম্যান মফিজার রহমান জানান, এই মাঠেই এখন থেকে নিয়মিত বাজার বসবে এবং দোকানপাট গড়ে উঠবে।
মাদ্রাসার মাঠের পাশে খালি জায়গায় স্থাপিত হবে বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর নামে ‘মুজিব-ইন্দিরা আদর্শ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
কোটভাজনী থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান আলতাফুর রহমান জানান, সেখানেও বিকেল থেকে নাচ, গান ও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। রাত ১২টায় মশাল, মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন বাংলাদেশকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে।
বোদা উপজেলার শালবাড়ী ও কাজলদীঘি ছিটমহলের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, তাঁরাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঘরে ঘরে ৬৮টি করে মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন বাংলাদেশকে বরণ করে নিয়েছেন।