আ.লীগের দুই পক্ষের বিবাদে বাউফলে আতঙ্ক, অশান্তি

মাগরিবের আজানের পরপরই বাজারের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন ঘরে ফিরছেন। ফলে সন্ধ্যার পরপরই প্রায় নীরব পটুয়াখালীর বাউফল বাজার। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের পর থেকেই এই উপজেলা সদরে এমন অবস্থা।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিবদমান দুই পক্ষের মারামারি, পাল্টাপাল্টি হামলা-মামলা, প্রতিপক্ষের বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুর এবং সশস্ত্র মহড়ার কারণে ছোট্ট এই উপজেলা শহরে এমন ভীতিকর অবস্থা বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ। পুলিশ মামলা নিলেও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অপারগ।
আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষে আছেন পটুয়াখালী-২ আসনের সাংসদ ও চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের সমর্থকেরা এবং অন্য পক্ষে আছেন বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক ওরফে জুয়েলের সমর্থকেরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ স ম ফিরোজ। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই পৌর মেয়র। প্রায় ১৮ বছর পর গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মেয়র জিয়াউল সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তাঁর পক্ষে আছেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ও একজন আমলা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ প্রথম সারির নেতারা চিফ হুইপের পক্ষে। অন্যরা মেয়রের পক্ষে। যুবলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বড় অংশ চিফ হুইপের পক্ষে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি চিফ হুইপের পক্ষে ও সাধারণ সম্পাদক মেয়রের পক্ষে। জেলা ছাত্রলীগের অনুমোদিত উপজেলা ছাত্রলীগ মেয়রের পক্ষে। তবে চিফ হুইপ তাঁর পক্ষে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি করেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, মূলত চিফ হুইপ সমর্থকদের আক্রমণাত্মক অবস্থানের কারণেই উপজেলায় এ রকম সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঈদের পর ২১ জুলাই পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে দুই পক্ষ। সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে দুই পক্ষ একে অন্যকে ঠেকাতে মাঠে নেমেছে। সশস্ত্র মহড়া চলেছে। পরিস্থিতি ঠিক রাখতে এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
বাউফল সদরে দোতলা বাড়ি হাতে গোনা। অধিকাংশ বাড়িঘরই টিনের। সদরের ভেতরের রাস্তাগুলো এত সরু যে দুটি গাড়ির পাশ কাটানোর পথ নেই। এমন রাস্তাতেই এখন সাইরেন বাজিয়ে টহল দিচ্ছে পুলিশের গাড়িগুলো। মোড়ে মোড়েও পুলিশ। পুলিশের তৎপরতায় বন্ধ হয়ে গেছে নিবন্ধনবিহীন মোটরসাইকেলের চলাচল। এ কারণে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলগুলোও চলছে না। ভাড়ার মোটরসাইকেল এলাকাবাসীর যাতায়াতের অন্যতম বাহন।
গত সোমবার দুপুরে সদরের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে কথা হয় এর মালিকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘ব্যবসা করতে পারতাছি না। সন্ধ্যার পর এলাকায় কোনো লোকই থাকে না।’ নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বললেন, পত্রিকায় নাম ছাপা হলে দোকান বন্ধ করে দেবে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় জনতা ভবনে গিয়ে দেখা গেল, চিফ হুইপের সমর্থকেরা অবস্থান করছেন। তাঁরা সেখানেই থাকেন, খান। তাঁদের আরেকটি দল থাকছে কালাইয়া গরুর হাটের পাশে এক জনপ্রতিনিধির বাড়িতে। আর শহরের মুসলিম পাড়ায় মেয়রের বাড়িতে অবস্থান করছেন তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা। তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই।
দুই পক্ষের বিবাদে ভাঙচুর হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মো. শিপনের মালিকানাধীন সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বাউফল পৌর ছাত্রলীগের নেতা মেহেদি হাসানের বাড়ির টিনে কুপিয়েছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ইউসুফ ও যুবলীগ নেতা ইব্রাহিমের বাবা আল ইসলামের কাঁচামালের দোকানে হামলা চালিয়ে তাঁকে মারধর করা হয়েছে। এঁরা মেয়রের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত।
কাঁচামাল ব্যবসায়ী আল ইসলাম বলেন, ২৫ জুলাই বেলা তিনটার দিকে চিফ হুইপের সমর্থকেরা মিছিল বের করে। মিছিলের পেছনেই পুলিশের একটি দল ছিল। মিছিলটি ঘুরে এসে তাঁর দোকানে হামলা চালায়। দোকানের ঝাপের আলগা বাঁশ নিয়ে তাঁকে পেটানো হয়। ক্যাশবাক্স ভাঙচুর ও লুট করা হয়। দোকানে থাকা অন্যদের মারধর ও কয়েকটি কাঁঠাল নষ্ট করে হামলাকারীরা চলে যায়। আল ইসলামের দুই ছেলে মেয়রের অনুসারী হওয়ায় এই হামলা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। আল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এইহানে ব্যবসা করি। হ্যাগো বিরুদ্ধে মামলা করলে কী আর এইহানে বইতে পারুম। হ্যারা আমার মোবাইলটা নিয়া গ্যাছে। আমার ব্যবসার সব যোগাযোগের নম্বর আছে হেইহানে। আমি স্যারেগো (পুলিশ) কইছি খালি আমার মোবাইলটা ফেরত নিয়া দ্যান।’
বিবাদের ইতিবৃত্ত: উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, দীর্ঘ সময় এলাকায় আ স ম ফিরোজের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ২০১২ সালে পৌর নির্বাচনে আ স ম ফিরোজের নির্দেশ অমান্য করে অনেক নেতা-কর্মী জিয়াউল হকের পক্ষে কাজ করেন। জিয়াউল হক নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই মূলত শুরু হয় এই দ্বৈরথ। জিয়াউল হকের পক্ষে কাজ করা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে প্রতিপক্ষ। তাঁদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুরসহ চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মেয়রের পক্ষে থাকায় চিফ হুইপ সমর্থক ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটিও রয়েছে।
পৌর মেয়রের বাড়ির পাশে কথা হয় উপজেলা ছাত্রলীগের অনুমোদিত কমিটির সভাপতি সাইদুর রহমান হাসানের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে তখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অন্তত¯১৫ জন নেতা-কর্মী ছিলেন। তাঁরা সবাই বললেন, তাঁরা এই সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে মুক্তি চান। রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারেন না। রাতভর পাহারা দিতে হয়। সবার বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়েছে। আরও মামলা দেওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে।
সাইদুর রহমানের অভিযোগ, চিফ হুইপের পক্ষে কাজ না করায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদ ও তিনিসহ অন্তত¯১৫০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাস্যকর অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় তাঁদের ধরার জন্য চিফ হুইপ পুলিশকে চাপ দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরের মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহাগ হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। এক দিন পরই অবশ্য আদালত থেকে তিনি জামিন পান।
পৌর মেয়র জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা তাঁকে (আ স ম ফিরোজ) অনুরোধ করব বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করতে।’
ফোনে যোগাযোগ করে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ৪০ বছর রাজনীতি করি। আমার এলাকার মানুষের কাছে আগে আপনি ভালোভাবে আমার সম্পর্কে শুনে আসেন। আপনি সাংবাদিক মানুষ, তারপর আপনি এলাকায় যা দেখছেন তা ছাপিয়ে দেবেন। এখানে আমার বলার কিছু নেই।’
বাউফল থানার কয়েকজন কর্মকর্তা বললেন, রাজনৈতিক দলাদলির এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ কোনো পক্ষÿনেবে না বলে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে চাপে পড়ে পুলিশ কিছু মামলা নিলেও কোনো তৎপরতা নেই। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগও নেই। তবে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাউফলে আসছেন। তদারকি করছেন।
বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ জা মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান হলে ভালো। উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয়, সে জন্য পুলিশ কাজ করছে। ইতিমধ্যে অনেকখানি উন্নতিও হয়েছে।