দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক নানা খাতে বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্যের হারও তাদের মধ্যে বেশি।
আদিবাসী নেতা ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় যুক্ত হলেও সেই উন্নয়নের ছোঁয়া কমই লেগেছে আদিবাসীদের ঘরে। তাদের উন্নয়নে বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মকাণ্ডের বাইরে সরকারের সমন্বিত কোনো কর্মসূচি নেই। এরই মধ্যে আজ ৯ আগস্ট পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস।
দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে সমতলে। বাকিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে। সরকারের আদমশুমারি, অর্থনৈতিক সমীক্ষা, আয়-ব্যয় খানা জরিপ এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদনে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আদিবাসীদের পিছিয়ে পড়ার তথ্য উঠে এসেছে।
চাকমা সার্কেল-প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়ের মতে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় থাকা বাংলাদেশে আদিবাসীদের পিছিয়ে থাকার কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসীদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেওয়া। আদিবাসীদের প্রতি কার্যত অবহেলা আছে রাষ্ট্রের। বাসুদেবপুর ও দেওপাড়া। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুটি ইউনিয়ন। সর্বশেষ জাতীয় আদমশুমারি ২০১১ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাসুদেবপুরের জনসংখ্যা ২৬ হাজার, দেওপাড়ার ৩৯ হাজার। বাসুদেবপুরের অধিবাসীদের প্রায় সবাই বাঙালি। আর দেওপাড়ার অধিবাসীদের এক-তৃতীয়াংশ আদিবাসী। এ দুটি ইউনিয়নের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়েই কেবল দেওপাড়া এগিয়ে, বাকি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে।
শুমারির তথ্য বলছে, বাসুদেবপুরের সাক্ষরতার হার ৫৭ শতাংশ। জনসংখ্যার ৭০ ভাগ চিঠি লিখতে পারে। এ ইউনিয়নের কাঁচাঘরের সংখ্যা মাত্র ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। পায়খানা নেই এমন পরিবারের সংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ।
উল্টো চিত্র দেওপাড়ার। সেখানে সাক্ষরতার হার ৫১ শতাংশ। জনসংখ্যার অর্ধেকই চিঠি লিখতে পারে না। কাঁচাঘরের সংখ্যা ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ৩০ শতাংশের বেশি মানুষের পায়খানা নেই।
দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান জানান, ইউনিয়নের ৭৫টি গ্রামের মধ্যে অন্তত ২৪টি আদিবাসী গ্রাম। গ্রামগুলোর ৮০ ভাগ মানুষই ভূমিহীন।
সামাজিক বৈষম্যের এ চিত্র কেবল পরিসংখ্যানে নয়, লালমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের এ ইউনিয়নের জিওলমারি, পান্থপাশা, চৈতন্যপুরে গ্রামের কাঁচা সড়ক, ঝুপড়ির ঘরগুলো বলছে, কেমন আছে সেখানকার আদিবাসীরা।
দেওপাড়ার আদিবাসী গ্রাম চৈতন্যপুরের বাসিন্দা বিমল চন্দ্র রাজোয়ার বলছিলেন, ‘ইউনিয়নের এতগুলো আদিবাসী গ্রাম অথচ কোথাও একটা মাধ্যমিক স্কুল পাবেন না। বর্ষায় আদিবাসী গ্রামগুলোর রাস্তা নষ্ট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় সব মানুষ দিনমজুর। বিদ্যুৎ, ভালো স্কুল, পাকা সড়ক—এসব আমাদের জন্য নয়।’
আদিবাসী গ্রামগুলোর অনগ্রসরতা দেওপাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি আদিবাসী। সেখানে ২০০৩ সাল থেকে ইউএনডিপির পরিচালনায় বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে। আর্থসামাজিক নানা খাতে আদিবাসীদের কিছু উন্নয়নও ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের তুলনায় তারা পিছিয়ে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। আর ইউএনডিপির ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপ বলছে, পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের দারিদ্র্যের হার ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ সাল অনুযায়ী, দেশে পরিবারপিছু বার্ষিক আয় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৮ টাকা। তবে ইউএনডিপির হিসাবে পাহাড়ের আদিবাসীদের আয় ৮৯ হাজার ১০১ টাকা। পুরো পার্বত্য এলাকায় বাঙালি-আদিবাসী মিলিয়ে ওই আয় ৯৩ হাজার ২৪৮ টাকা।
২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে পরিবারপিছু আয় বেড়েছে ৫৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সেখানে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে পার্বত্য এলাকায় আদিবাসীদের আয় বেড়েছে ১১ শতাংশ।
পানি ও স্যানিটেশন খাতে গত দুই দশকে বাংলাদেশের জাতীয় অর্জন ব্যাপক। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে ইউএনডিপির খানা জরিপ (অপ্রকাশিত) অনুযায়ী পাহাড়ের আদিবাসীদের মাত্র ৪৭ শতাংশ সুপেয় পানি পায়, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে আদিবাসী ও বাঙালি মিলিয়ে সুপেয় পানি পায় ৫৯ শতাংশ এবং পায়খানা ব্যবহার করে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
২০১০ সালে প্রকাশিত ‘লাইফ অ্যান্ড ল্যান্ড অব আদিবাসিস’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, সমতলের ৬০ শতাংশ আদিবাসী চরম দরিদ্র। ওই সময় জাতীয় পর্যায়ে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব আছে। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার সঠিক চিত্রও জাতীয় পর্যায়ে নেই।
বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসী-আয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে দেখা যায়, ৬৪টি জেলার মধ্যে গত এক দশকে সবচেয়ে কম বিদেশ গেছে এমন পাঁচটি জেলার মধ্যে প্রথমে রয়েছে বান্দরবান। এই তালিকায় আরও রয়েছে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি।
অপরাপর জনগোষ্ঠীর চেয়ে আদিবাসীরা যে পিছিয়ে তা স্বীকার করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘আদিবাসীদের উন্নয়নে নেওয়া কর্মসূচিতে যে সমন্বয়হীনতা আছে, তা অস্বীকার করব না। তবে তাদের উন্নয়নে আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই।’
(তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি)