প্রশাসন ও পুলিশের ভুল, খেসারত দিচ্ছে নিরপরাধ ছাত্র

মারামারি হয়েছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে। এর সাতেপাঁচে না থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হতে হয়েছে আরিফুল ইসলামকে। ভুল বুঝতে পেরে কর্তৃপক্ষ পরে তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু চার বছর আগের মারামারির ওই ঘটনায় করা মামলার ঘানি এখনো টানতে হচ্ছে তাঁকে। কিছুদিন আগেও আরিফুলকে গ্রেপ্তার করতে তাঁর বাড়িতে যায় পুলিশ।
ঘটনাটি ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিলের। চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক সংগঠন ‘একাকার’ পক্ষের নেতা-কর্মীদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় বগিভিত্তিক আরেকটি পক্ষ ‘উল্কা’। এতে একাকারের তিনজন নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। হামলার পরদিন একাকার পক্ষের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সাইফুদ্দীন খালেদ বাদী হয়ে উল্কা পক্ষের ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় মামলা করেন। এতে ১০ নম্বর আসামি হিসেবে মার্কেটিং স্টাডিজ বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আরিফের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওই বর্ষে মোহাম্মদ আরিফ হোসেন ও আরিফুল ইসলাম নামে দুজন শিক্ষার্থী ছিলেন।
ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, হামলার ঘটনায় জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ আরিফ হোসেন। তাঁকেই মামলায় আসামি করেন সাইফুদ্দীন খালেদ। কিন্তু নামবিভ্রাটের কারণে ওই বছরের ১ মে হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছয়জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে। বহিষ্কারের তালিকায় ভুলবশত মোহাম্মদ আরিফ হোসেনের পরিবর্তে নিরপরাধ আরিফুল ইসলামের নাম ঢুকে যায়। আরিফকে দুই বছর বহিষ্কার করা হয়। হতভম্ব আরিফ বহিষ্কারের বিষয়টি জানতে পেরে ৩০ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চিঠি দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। এরপর ২৭ জুন আরিফের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি দেওয়া হয়। এতে বহিষ্কারাদেশের তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করা হয় এবং নতুন করে মোহাম্মদ আরিফ হোসেনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু হামলার ঘটনায় করা মামলায় আরিফুল ইসলামের নাম থেকে যায়। এ বিষয়ে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘২০১১ সালের ২৮ মে রাউজানের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে গেলে আমি প্রথম বিষয়টি জানতে পারি। পরে একই বছরের ৩০ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হামলার ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নই বলে আবেদন করি।’
যাচাই-বাছাই ছাড়া আরিফুল ইসলামকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে ওই সময় প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আকতার হোসেন বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। ভুল ধরা পড়ার পর আরিফুলের নাম বহিষ্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁর প্রতি প্রশাসন সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু আরিফুলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। মামলা থেকে তাঁর নাম বাদ দিতে পুলিশকে বলা হয়।
তবে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বহিষ্কারের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ায় ভেবেছিলাম সব ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এ বছরের মে মাসে আবারও পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে রাউজানের বাড়িতে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মামলার অভিযোগপত্রে আমার নাম আছে।’
আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সামনে আমার এমবিএ পরীক্ষা। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি। কিন্তু মামলা থাকায় যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারি—এই ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মামলার আসামি হওয়ায় চাকরির ক্ষেত্রেও ঝামেলা হতে পারে।’
মারামারির মামলার বাদী সাইফুদ্দীন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মামলায় আসামি করি আরিফ হোসেনকে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভুলবশত রাউজানের আরিফুল ইসলামকে বহিষ্কার করে ফেলে। যদিও পরে তাঁর নাম বহিষ্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ কোনো যাচাই-বাছাই না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রথম আদেশের ভিত্তিতে আরিফুল ইসলামের নাম মামলার অভিযোগপত্রে রাখে। মানবিক দিক বিবেচনা করে আরিফুল ইসলামকে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরিফ হোসেনকে এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাইব।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে একজন নিরপরাধ ছেলেকে চার বছর ধরে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আমি ওই মামলার বাদীকে বলেছি, আরিফুল ইসলামের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সত্যিকার অপরাধীর নাম অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল হাশেম। ২০১২ সালের ৯ জুলাই আরিফুলসহ ১২ জনকে আসামি করে তিনিই অভিযোগপত্র দেন।
তদন্তে কেন নিরপরাধ ছাত্রকে মামলার আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, সে বিষয়ে রেলওয়ে থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিমাংশু দাশ বলেন, ‘বিষয়টি অনেক আগের। আর বর্তমানে এম এ হাশেম আমার থানায়ও কর্মরত নেই। মামলার বাদীর সঙ্গে আলোচনা করে ভুক্তভোগী ছাত্র এ ব্যাপারে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। থানা থেকে এ বিষয়ে কিছু করার নেই এখন।’