ক্যামেরা বসিয়ে গৌরীপুর শাসন করছেন সাংসদ

গৌরীপুর উপজেলা সদরে যুবলীগ নেতা আবু কাওসার চৌধুরীর,বাসার সামনে সাংসদের বসানো ক্যামেরা l ছবি: প্রথম আলো
গৌরীপুর উপজেলা সদরে যুবলীগ নেতা আবু কাওসার চৌধুরীর,বাসার সামনে সাংসদের বসানো ক্যামেরা l ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সাংসদ মজিবুর রহমান ফকির তাঁর নির্বাচনী এলাকায় নজরদারির জন্য সরকারি অফিস, থানা, স্কুলসহ বিভিন্ন জায়গায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের নজরদারি-ব্যবস্থায় সরকারের কোনো অনুমোদন নেই। তবে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করার এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।
সাংসদের ক্যামেরার আওতা থেকে বাদ পড়ছে না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও গৌরীপুর থানা কার্যালয়ও। তা ছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রতিপক্ষদের বাসা ও আড্ডাস্থলকেও আনা হচ্ছে এই ক্যামেরার আওতায়।
গৌরীপুরের পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যালয় এবং রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে ইতিমধ্যে নয়টি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এসব ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি সার্বক্ষণিক তদারকি করতে সাংসদের প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর কার্যালয়ে’ মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। সেখানে টিভি মনিটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বসানো হয়েছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা জানান, এসব সরঞ্জাম কিনতে তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। ধরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাজহারুল আনোয়ার ফেরদৌস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দুটি এসি দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
সাংসদের নির্দেশে উপজেলায় সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজটি তদারক করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। যোগাযোগ করা হলে আবুল কালাম বলেন, উপজেলার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য এই ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এর পেছনে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই। তিনি বলেন, উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে মাদকসেবীরা মাদক নিচ্ছে। প্রকাশ্যে নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এ কারণে ক্যামেরা বসানো হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার গৌরীপুর পৌরসভার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ছয়টি ক্যামেরার দেখা মেলে। অন্য একটির জন্য তার টেনে রাখতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু চত্বর কার্যালয় থেকে তার টেনে নিয়ে এই ক্যামেরাগুলো বসানো হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের ভেতরে স্থাপিত ক্যামেরাটি উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের বারান্দায় বৃহস্পতিবার দুপুরে বসানো হয়। দুটি ক্যামেরা হাতে ঘুরতে থাকা একজন কর্মচারী জানালেন, এই ক্যামেরা দিয়ে দেড় শ ফুট দূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কার্যালয়ে কারা আসছেন বা কারা যাচ্ছেন, তা দেখা যাবে এই ক্যামেরায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গৌরীপুর থানায় ক্যামেরা বসাতে যান সাংসদের লোকেরা। তাঁরা তার টেনে থানার ভেতরে নিয়ে যান। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সেখানে ক্যামেরা বসানোর অনুমতি দেয়নি। পুলিশের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সাংসদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাংসদকে তাঁরা জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি ছাড়া থানায় ক্যামেরা বসাতে দেওয়া যায় না।
গৌরীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী শেখ বলেন, থানায় ক্যামেরা স্থাপনের জন্য তাঁরা অনুমতি দেননি। শহরের বিভিন্ন স্থানে ক্যামেরা স্থাপন করা হবে কি না, সে ব্যাপারে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তবে থানায় ক্যামেরা বসাতে না দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন আবুল কালাম আজাদ।
শহরের বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আর মহিলা কলেজে যাওয়া-আসার পথে জোড়পুকুর মোড়ে বসানো হয়েছে আরেকটি ক্যামেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক বলেন, এটা অন্যায়। মেয়েদের যাওয়া-আসার পথে ক্যামেরা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এই পথে সাংসদের কার্যালয় থাকায় সেখানে সারাক্ষণই নেতা-কর্মীরা দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের কারণে এমনিতে শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে ভোগে। এখন আবার ক্যামেরা বসানোর কারণে এই অস্বস্তি আরও বেড়ে যাবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে নিজামউদ্দিন, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবু কাওসার চৌধুরী, সাবেক মেয়র শফিকুল ইসলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা তায়েবুর রহমানের বাসার সামনে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই নেতারা সাংসদের প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত।
নিজামউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাসায় আওয়ামী লীগের নেতারা আসেন, আড্ডা দেন। ঈদের পরদিন তাঁর বাসায় হামলা করেন সাংসদের লোকেরা। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক মোরশেদুজ্জামান সেলিমসহ কয়েকজন আহত হন। তিনি বলেন, এখানে কারা আসছেন, তা দেখার জন্য সাংসদ ক্যামেরা বসিয়েছেন। অবশ্য এ নিয়ে নিজামউদ্দিন কারও কাছে অভিযোগ করেননি।
জানতে চাইলে ইউএনও দুর রে শাহ্ওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ এভাবে ক্যামেরা বসাতে পারেন না। মানুষের ব্যক্তিগত চলাফেরা এভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। একমাত্র সরকার চাইলেই প্রয়োজনে এটা করা যেতে পারে। তাঁর কার্যালয়ের ভেতরে ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি প্রতিবেদকের কাছে শুনে তিনি বলেন, তিনি দ্রুত এটা খুলে ফেলবেন। কোনোভাবেই এটা রাখতে দেবেন না। তাঁর কার্যালয়ে কারা আসছেন, সেটা অন্য কারও মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। ইউএনও বলেন, তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। বৃহস্পতিবার কাজে যোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাবেন।
ক্যামেরা বসানোর কারণ: পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে ক্যামেরা স্থাপনের কিছু কারণ জানা গেছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শিক্ষক, সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর, গালাগাল করার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কখনো মামলা করেননি। এমনকি সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেননি।
কিন্তু সম্প্রতি উপজেলার ধরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাজহারুল আনোয়ার ফেরদৌস সংবাদ সম্মেলন করে সাংসদের লোকদের বিরুদ্ধে চাঁদা নেওয়া ও মারধরের অভিযোগ করেন। এই অভিযোগে তিনি মামলাও করেছেন।
মামলায় সরাসরি নাম না থাকলেও মারধরের ঘটনায় সাংসদের সম্পৃক্ততা আছে বলে ওই শিক্ষক প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া সাংসদের প্রতিপক্ষ অনেকেই এখন থানায় যাতায়াত করছেন। থানায় ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্তের পেছনে এটাকে কারণ হিসেবে দেখছেন সাংসদের দুই ঘনিষ্ঠজন। তাঁরা বলেছেন, গৌরীপুরের কেউ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন, এটা সাংসদ ভাবতেও পারেননি।
ইউএনও দুর রে শাহ্ওয়াজ এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া ইসলাম (লিলি) কয়েকবার সাংসদের কিছু কাজের বিরোধিতা করেছেন। এই দুজনকে সাংসদ প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেন। আর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তায়েবুর রহমান বিএনপি-সমর্থিত হওয়ায় সাংসদ তাঁকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এই প্রতিবেদক সাংসদের বাসায় গেলেও তিনি কথা বলেননি। এরপর ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
সম্প্রতি চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী মুতাসিম মাহিরকে উপজেলার কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধা দেওয়ায় আলোচনায় আসেন সাংসদ মজিবুর রহমান। মাহিরের বাবা মাজহারুল আনোয়ারের বদলিসংক্রান্ত বিষয়ে সাংসদের সঙ্গে বিরোধের কারণে শিশুটিকে ভর্তি হতে বাধা দেওয়া হয়। গতকাল শনিবার পর্যন্ত শিশুটি কোনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।
মাজহারুল প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধ মীমাংসার জন্য সাংসদের সমর্থকেরা তাঁর কাছে দুটি এসি দাবি করেন। ছেলের কথা ভেবে তিনি এসি কিনে দেন। সাংসদের সমর্থকেরা তাঁকে ও তাঁর ছেলের পা ভেঙে ফেলার হুমকি দিলে তিনি সাংসদের চার সমর্থকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।