সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে পাঁচ আদিবাসী নিহত

সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে পাঁচ আদিবাসী যুবক নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার ভোরে বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের বড় আদাম গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবকদের শরীরে সেনাবাহিনীর পোশাক (ইউনিফর্ম) ছিল।
সেনাবাহিনীর দাবি, নিহত যুবকেরা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সশস্ত্র সদস্য। তবে দুটি সংগঠনই তা অস্বীকার করেছে। গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং জনসংহতি সমিতির (সন্তু লারমা) দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত পাঁচ মাসে বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির এটি দ্বিতীয় ঘটনা।
ঘটনাস্থল থেকে দুটি চায়নিজ রাইফেল, তিনটি এসএলআর (এম-১৬), গুলিভরা ম্যাগাজিনসহ একটি এলএমজি, একটি এসএমসি, একটি পিস্তল, সেনাবাহিনীর ছয়টি প্যান্ট, ১০টি শার্ট ও টুপি এবং কোমরে গুলি রাখার বেল্ট উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাগুলিতে লিয়াকত আলী নামে সেনাবাহিনীর একজন কর্পোরাল আহত হয়েছেন। তাঁকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
গুলিতে নিহত যুবকেরা হলেন তাতুমণি ত্রিপুরা (২৮), জ্যাকসন চাকমা (২৫), রূপায়ণ চাকমা (২৪), কান্তি মারমা (২৮) ও বাবুল চাকমা (২০)। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার সিদ্দিকীর ভাষ্যমতে, ২০ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল বড় আদাম গ্রামে অবস্থান করছে এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা সেখানে যান। শুক্রবার রাতে তাঁর এবং মেজর আশিক বিন জলিলের নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা সন্ত্রাসীদের ঘিরে ফেলেন। বিষয়টি টের পেয়ে ভোর পাঁচটার দিকে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় সেনাসদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। দুই পক্ষে প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলি হয়। এ সময় কমপক্ষে ৪৫০টি গুলিবিনিময় হয়।
গোলাগুলিতে আরও কয়েকজন সন্ত্রাসী আহত হওয়ার দাবি করে আলী হায়দার সিদ্দিকী জানান, সন্ত্রাসীরা যে পথে পালিয়ে গেছে, সে পথে রক্তের দাগ দেখা গেছে। তবে নিহত বাবুল চাকমার স্ত্রী শিপা চাকমা দাবি করেন, তাঁর স্বামী সন্ত্রাসী নন। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবুল মারা গেছেন। তাঁদের বাড়ি সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট দীপুপাড়ায়। শুক্রবার রাতে বড় আদাম গ্রামে বেড়াতে যান তাঁর স্বামী। শিপা চাকমা এখন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পেটের বাচ্চাকে নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব?’
গতকাল সকাল আটটায় গিয়ে দেখা যায়, বড় আদাম গ্রামের উত্তর পাশের শেষ সীমানায় একটি টিলার ওপর দুটি বাড়ি। ওই টিলা এবং আশপাশের এলাকা সেনাসদস্যরা ঘিরে রেখেছেন। টিলার ওপরে জ্ঞানজ্যোতি চাকমার বাড়ির উঠানে দুটি এবং বাড়ির পাশে তিনটি লাশ পড়ে আছে। ঘরের বাঁশের বেড়ায় এবং উঠানের পাশের কয়েকটি গাছে গুলির চিহ্ন রয়েছে। বেলা ১১টার দিকে বিজিবির মারিশ্যা জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
টিলার ওপরে থাকা দুটি বাড়ির একটি জ্ঞানজ্যোতি চাকমার। তিনি জানান, শুক্রবার রাত নয়টার দিকে প্রায় ২০ জনের একটি সশস্ত্র দল তাঁর এবং পাশের বিনয়জ্যোতি চাকমার বাড়িতে আসে। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভাগাভাগি করে দুটি বাড়িতে অবস্থান করে। সন্ত্রাসীরা সকালে চলে যাবে বলে জানায় তাঁদের।
বিনয়জ্যোতি চাকমা জানান, ভোর পাঁচটার দিকে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় সবাই খাটের নিচে আশ্রয় নেন। তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়। গোলাগুলির ঘটনা এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
ইউপিডিএফের তথ্য বিভাগের প্রধান নিরন চাকমার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, একটি বিশেষ মহল ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে গোলাগুলির ঘটনায় ইউপিডিএফকে জড়াতে চাচ্ছে।
অপরদিকে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কোনো সশস্ত্র শাখা নেই। তাই সন্ত্রাসীরা তাঁদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
এর আগে গত ২৩ এপ্রিল উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের এগুজ্জেছড়ি এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল দলের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গুলিবিনিময় হয়। এতে একজন নিহত এবং অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।
বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকির হোসেন জানান, পুলিশ বাদী হয়ে গোলাগুলির ঘটনায় থানায় অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে।