সব সময় নিঃসঙ্গ ছিলাম আমি

চুরাশিতে পা দিলেন মুর্তজা বশীর l ছবি: নাসির আলী মামুন
চুরাশিতে পা দিলেন মুর্তজা বশীর l ছবি: নাসির আলী মামুন

অভিবাদন শিল্পী মুর্তজা বশীর। আজ শিল্পীর ৮৪তম জন্মদিন। বাংলাদেশের চারুকলার বর্ণিল ইতিহাসের অন্যতম প্রধান শিল্পী তিনি। বর্ণাঢ্য জীবন তাঁর। পূর্ব ও পশ্চিমের আধুনিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসম্ভারে উল্লিখিত হয়েছে। লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতা। গবেষণাগ্রন্থ আছে একটি। বহুমাত্রিক এই ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ুন কবীর-এর উপন্যাস নদী ও নারীর চিত্রনাট্য, শিল্প নির্দেশনা এবং পরিচালকের প্রধান সহকারী হয়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৯৬৯-এ ছোটগল্প ‘কাঁচের পাখীর গান’ এবং ১৯৭৮-এ উপন্যাস আলট্রামেরিন প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছিল।
উপন্যাস, গল্প বা চলচ্চিত্রের মতো যাপিত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত ও সৃষ্টিশীল জীবন এবং আমাদের প্রত্যাশা ছিল তিনি আত্মজীবনী লিখে যাবেন। ছাপার অক্ষরে নিজের জীবনকে মেলে না ধরলেও তাঁর সৃজনশীল লেখার আড়ালে মুর্তজা বশীর বর্ণনা করেন নিজেকেই, এমনকি অনেক চিত্রকর্মের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থিত করেছেন ক্যানভাসে ও কাগজে। আত্মজীবনী লেখার স্বাভাবিক ও সহজিয়া পথ থেকে থেকেছেন বিচ্ছিন্ন। তাঁর বিচ্ছিন্ন আত্মকথন নিয়ে সংকলন বেরিয়েছে, কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লিখলেন না তিনি।
মুর্তজা বশীর ১৯৫০ সালের ২৭ মার্চ মাত্র ১৭ বছরে প্রথম নিজের ছবি আঁকেন। এ পর্যন্ত তাঁর আত্মপ্রতিকৃতির সংখ্যা প্রায় ১২৫টি। কয়েক খণ্ডে নিজের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখার প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু হয়নি। আলট্রামেরিন-এ তাঁর যৌবনের প্রারম্ভ থেকে ইতালি যাওয়ার আগ-পর্যন্ত ব্যক্তিজীবন উপন্যাস আকারে লিখেছেন।
বেদনা ছাড়া লিখতে পারেন না এবং আনন্দ ছাড়া আঁকতে পারেন না মুর্তজা বশীর।
আত্মপ্রতিকৃতিতে মুর্তজা বশীর যেমন যত্নবান, তেমনি সেসব প্রতিকৃতিতে বিষণ্ন, অতৃপ্ত এবং নিঃসঙ্গ রূপের এক অভাবনীয় রূপকার হিসেবে প্রকাশ করেছেন নিজেকে। মনে হয় অনেকের মধ্যে থেকেও তিনি একা এবং সতত নিমগ্ন অন্য এক দূর ভুবনে। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সমাজ এবং যখন তিনি আর থাকবেন না তখন তো তাঁর কাছে সমাজ থাকছে না। তিনি তখন নিঃসঙ্গ এক অচেনা ভুবনের বাসিন্দা।
১৭ বছর বয়স থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিজেকে এঁকেছেন নিবিড়ভাবে। আঁকতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে অনেক সময় প্রশ্ন করেছেন, আমি কে। এক মানবজীবনের শতাধিক পর্যায় যখন এমন একজন কিংবদন্তি শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজেকে সৃজন করেন তখন এর চেয়ে বৃহৎ আত্মকথন আর কী হতে পারে? প্রত্যেক বছর এক বা একাধিকবার নিজেকে আঁকেন। তিনি বলেছেন, তার মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হলে এক রকম, খুব আনন্দে থাকলে আরেক রকম এঁকেছেন। যখন ‘ওয়ান’ সিরিজ আঁকলেন ১৯৬৬-তে ঢাকায়, দেখলেন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের দম-বন্ধ অবস্থা। তারপর আর্থসামাজিক কারণে পিতা-পুত্র বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে দূরত্ব, মনে হচ্ছে এক ঘরে থেকেও আমরা একজন অন্যজনকে বুঝতে পারছি না। কোথাও যেন অদৃশ্য দেয়ালের মতো।

আত্মপ্রতিকৃতি ১৯৭৯
আত্মপ্রতিকৃতি ১৯৭৯

বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, এঁকেছিলেন পোস্টার। গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। মানুষ যখন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল সবকিছুকে অবিশ্বাস করে তখন তিনি আঁকলেন ‘উইংস’। সুন্দর একটি আগামীর কথা মানুষকে বলতে চেয়েছিলেন এবং সুন্দর প্রজাপতির ক্ষণস্থায়ী জীবন-এর রঙিন পাখা।
তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ইতালির ফ্লোরেন্সে। দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত একক প্রদর্শনীর সংখ্যা ২৭টি। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান মুর্তজা বশীর ম্যুরাল করেছেন বেশ কয়েকটি, যা তাঁর আরেক মাধ্যমের মুনশিয়ানা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আত্মপ্রতিকৃতি ২০০২ সাল
আত্মপ্রতিকৃতি ২০০২ সাল

‘আমার কোনো বন্ধু নাই’—বহুবার তাঁকে বলতে শুনেছি। ‘আমিই আমার বন্ধু,’ আবার এও বলেছেন, ‘আমার বিপদে, আমার কষ্টে ও সুখে আয়নার সামনে দাঁড়াই। আর সেই লোকটাকে দেখি যে আমার প্রতিবিম্ব, সে হলো আমার প্রকৃত বন্ধু। আমার যখন চোখের ছানি অপারেশন হলো, আমি আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালাম, আমার চেহারাটা দেখলাম, আমি আঁকলাম। আমি যখন হাসপাতালে মরণাপন্ন, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আয়নায় আবার দাঁড়ালাম এবং তাঁর কাছে আমি নিবেদন করলাম, আমি তাকে আঁকলাম। সব সময় নিঃসঙ্গ ছিলাম আমি।’
আজকে জন্মদিনে কিংবদন্তিতুল্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরকে শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তিনি একা নন, বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার আদি থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বহমান ইতিহাস তাঁকে ধারণ করে আছে। জীবনের এই গোধূলিবেলায় একক চিত্র প্রদর্শনী করে আমাদের আবারও মুগ্ধ করবেন—এই আনন্দেই রইলাম আমরা।