জ্বলার আগেই নেভার শঙ্কা

.
.

ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত বা সিগন্যাল বাতির সাহায্যে যানবাহন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই তা বন্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় না।
গত ১৭ মে রাজধানীর ১২টি মোড়ের সংকেত বাতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর শাহবাগ থেকে বনানী পর্যন্ত মূল সড়কটি প্রচণ্ড যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে। এরপর সংকেত বাতি আর চালু করা হয়নি।
এগুলো চালু হলে যানজট বেড়ে যাবে—এই আশঙ্কায় পুলিশ আগেভাগে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পুলিশ বলছে, এর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, অর্থ ও দক্ষতা তাদের নেই। অন্যদিকে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট ছয়টি মন্ত্রণালয় ও কয়েকটি বিভাগ বিষয়টি নিয়ে একধরনের অস্বস্তিতে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ বাবদ প্রায় ৫৫৫ কোটি টাকা (৭১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার) নিয়ে ২০০৯ সালে ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেইস) প্রকল্প গ্রহণ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। বায়ুদূষণ রোধ ও যানজট নিরসনে নেওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন, যার একটি বড় অংশ খরচ করা হচ্ছে ১০০ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা স্থাপনে। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে পুলিশের কাছে এসব সিগন্যাল হস্তান্তরের প্রসঙ্গ উঠতেই টানাপোড়েন শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। তবে প্রকল্পের আওতায় নতুন ফুটপাত স্থাপন বা আধুনিকায়ন, নতুন মোড় তৈরিসহ আরও কিছু কাজ রয়েছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটি বেশ আগের প্রকল্প। কোন প্রেক্ষাপটে ট্রাফিক সিগন্যালের প্রকল্প তাঁর মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছিল, তা তিনি বলতে পারবেন না। তবে এটি কীভাবে কার্যকর করা যায়, মন্ত্রণালয় সেই চেষ্টা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসন ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যে প্রকল্পের লক্ষ্য যানজট নিরসন, যে প্রকল্পের আওতায় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হবে, দাতাদের টাকায় সেই প্রকল্প নিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। আর এর বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এটা যেভাবে ট্রাফিক পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা যৌক্তিক নয়।
ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলে যাবে। কিন্তু এটি চালানোর দায়িত্বে থাকবে পুলিশ। শহরবাসী রাস্তায় পুলিশকেই দেখবে। এ ধরনের অত্যাধুনিক সংকেতব্যবস্থা অকেজো হলে শহরজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। পুলিশ এর অংশ না হলেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়বে।
এর আগে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (ডিইউটিপি) আওতায় (২০০৪ থেকে ২০১২) ঢাকায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯টি সিগন্যাল স্থাপন করা হলেও সেগুলোর একটিও চালু নেই, যা নিয়ে নগর বিশেষজ্ঞদের কড়া সমালোচনা রয়েছে। প্রায় ৯০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে মানসম্মত ফুটপাত স্থাপনসহ সড়ক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেইস প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত সিগন্যালগুলোর কার্যক্রম পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে ট্রাফিক বিভাগ বাস্তব কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্রাফিক সংকেত বাতি ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও বাজেট বরাদ্দ নেই। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে চাইলে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট দরকার। এ বিষয়টি জানিয়ে গত ২ মার্চ ডিএমপির পুলিশ কমিশনার স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকেও চিঠি দেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক পুলিশের এই যুক্তি বাস্তবসম্মত বলে মত দিয়ে বলেন, সবকিছুর শেষে দায় পুলিশকে নিতে হবে বলেই তারা এবার সতর্ক। তিনি বলেন, চোখ ও হাত দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করাটা দৃষ্টিকটু। তাই শহরে চলাচলে স্বস্তি ও শৃঙ্খলার জন্য এবং পথচারীর নিরাপত্তায় এ ধরনের সংকেত বাতি চালু করতেই হবে। তবে লাগসই ও টেকসই করার জন্য এর রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি। কারণ, এটা ঝরনার মতো একটি সিগন্যাল আরেকটি সিগন্যালকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি আরও বলেন, এই সিগন্যাল পদ্ধতি মাঝেমধ্যে হালনাগাদ করতে হবে। কারণ, গাড়ি বাড়বে, সড়কের গতি ও মোড় পরিবর্তন হবে।
সামছুল হক মনে করেন, ট্রাফিক সিগন্যাল এখন যে অবস্থায় আছে, তাতে এটি ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক, সফল হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।
এদিকে ৬ আগস্ট স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খানের সভাপতিত্বে ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কাছে হস্তান্তরবিষয়ক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে দক্ষ জনবল, লজিস্টিকস সাপোর্ট ও পৃথক বাজেট বরাদ্দ দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট বা নিয়ন্ত্রণকক্ষ গঠন করতে বলা হয়।
উল্লেখ্য, ১৩ এপ্রিল পুলিশের মহাপরিদর্শকের সভাপতিত্বে এক সভায় শাহবাগ থেকে বনানী পর্যন্ত ১২টি ট্রাফিক সিগন্যালে স্বয়ংক্রিয় টাইমার কাউন্ট ডাউন পদ্ধতি চালু করা হয়। গত ১৫ ও ১৬ মে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় শহরের যানজট সহনশীল ছিল। কিন্তু ১৭ মে ঢাকা শহর যানজটে স্থবির হয়ে পড়লে পরদিন এই সংকেত বাতি স্থগিত করা হয়।
আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার কথা। যদিও প্রকল্পের সংশোধিত মেয়াদ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে এবং এ ধরনের ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও বরাদ্দ ছাড়া পুলিশ এই দায়িত্ব নেবে না।
তবে প্রকল্প সূত্র জানায়, পুলিশের এ দাবি মেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রকল্প পরিচালক দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কোথায়, কটি সিগন্যাল: প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় মোট ১০০ ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করা হবে। এর মধ্যে ৪০টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এবং ৩০টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। এগুলোর মধ্যে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের কারণে এবং দুটি একমুখী রাস্তার কারণে আটটি সিগন্যাল স্থাপন করা হয়নি।
প্রকল্পের আওতায় দুই সিটি করপোরেশনে আরও ৩০টি সিগন্যাল লাইট স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি সিগন্যালে থাকছে সোলার প্যানেল, সময় গণনা যন্ত্র, সোলার কনভার্টার, সোলার ইনভার্টার, জেল ব্যাটারি, সিগন্যাল কন্ট্রোলারসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি।
সোলার প্যানেল দিয়ে পরিচালিত প্রতিটি সিগন্যালে জেল ব্যাটারি দেওয়া হয়। মূল্যবান হওয়ায় এই ব্যাটারি চুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এটা চুরি হলে বা নষ্ট হলে তা কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, সে বিষয়টিও আলোচনায় আসছে।